নিজেদের উদ্ভাবিত বিনা হালে রসুন লাগানোর ধুম পড়েছে নাটোরের গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রামসহ চলনবিল এলাকায়। চলতি মৌসুমে স্থানীয় কৃষকরা অধিক লাভের আশায় ব্যাপক হারে সাদা সোনা খ্যাত মসলা জাতীয় ফসল রসুন লাগাতে শুরু করেছে। বাজারে রসুনের দাম ভালো থাকায় এমন আগ্রহ চাষিদের।
গুরুদাসপুরসহ চলনবিলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রসুন চাষকে ঘিরে কর্মমুখর হয়ে উঠেছে কৃষক পরিবারগুলো। কৃষক-কৃষাণী, কিংবা তাঁদের নিয়োগ করা মহিলারা রসুন থেকে কোয়া ছাড়ানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বাদ যাচ্ছে না বাড়ির কিশোর-কিশোরীরাও। অধিকাংশ পরিবার গ্রামের মহিলাদের রসুন ভাঙার কাজে নিয়োগ করেছেন। এ জন্য প্রতিমণ রসুন ভাঙার মুজুরি দেওয়া হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। একমণ রসুন ভাঙতে সময় লাগে দুদিন। পাশাপাশি চলছে জমি প্রস্তুতসহ রসুন রোপণের কর্মযজ্ঞ।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কৃষি উপকরণ বীজ, সার-কীট নাশক, সেচ, নিড়ানি, শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধির কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছরে রসুন চাষে প্রতি বিঘায় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। তবে রসুনের সাথি ফসল তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ করে কিছুটা লাভ হওয়ায় এখনো এই আবাদ ধরে রেখেছেন কৃষকেরা। রসুনের সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা, কাছিকাটা, হাঁসমারী, দড়ি হাঁসমারী, শিধুলী, চড়কাদহ, মশিন্দা, বড়াইগ্রামের বাজিতপুর, মাড়িয়া, ইকড়ি, জালশুকা, তারানগর, শ্রীরামপুর, মানিকপুর, উপলশহর, চকপাড়া, রয়না ভরট, মামুদপুর, রয়না, রোলভা, খাকসা, চড়ইকোল, তাড়াশের নওগাঁ, তালম, বারুহাস, সগুনা, দেশীগ্রাম, মাধাইনগর, মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা, কাটেঙ্গা, কোকড়াগাড়ি, ধানকুনিয়া, লাঙ্গলমোড়া, বরদানগর, ধুলাউড়ি, বোয়ালমারি, গৌরনগর, বিন্যাবাড়ি, নিমাইচড়া এলাকায়।
গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন জানান, এ বছর ৬ বিঘা জমিতে রসুন চাষ করেছি। বিঘা প্রতি বীজ, সার-কীটনাশক ও সেচ বাবদ খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। রসুন রোপণ ও নিড়ানিসহ শ্রমিক খরচ হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। এতে তার বিঘা প্রতি মোট ৩২ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে তিনি রসুনের সাথি ফসল হিসেবে ৬ বিঘা জমিতেই বাঙ্গি আবাদ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সেখান থেকে প্রতি বিঘায় উৎপাদন খরচ বাদে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাভ করা যাবে।
একই উপজেলার পাটপাড়া গ্রামের কৃষক রহমত আলী জানান, তিনি চলতি বছরে ৫ বিঘা বর্গা (লিজ) নিয়ে রসুন আবাদ করেছেন। রসুন চাষে খরচ বাড়ায় গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে প্রতি বিঘায় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা বেশি খরচ হয়েছে। উপায়ান্ত না পেয়ে সমিতি (এনজিও) থেকে লক্ষাধিক টাকা সুদ নিয়ে রসুনের আবাদ করেছেন।
চলনবিলের রসুন চাষী আলমগীর হোসেন, ছলিম উদ্দিন, কাওছার হোসেন ও আরিফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন জানান, চলনবিল অঞ্চলে ‘বিনাচাষে রসুন’ আবাদ শুরু হয়েছে প্রায় ২৩ বছর ধরে। এ বছর বাজারে রসুনের দাম ভালো থাকায় ঋণ কর্জ করে জমিতে রসুন রোপণ করছেন তারা। আশানুরুপ দাম না পেলে পথে বসতে হবে তাদের।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালে গুরুদাসপুর উপজেলার সিধুলি গ্রামের কৃষক বিমল পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রথায় রসুন চাষ শুরু করেন। এতে ফলন ও দাম ভালো পান। পরের বছর তিনি বাণিজ্যিকভাবে ৮ বিঘা জমিতে বিনাহালে রসুনের আবাদ করে অধিক লাভবান হন। তাঁর পথ ধরেই বিনাহালে রসুন চাষ পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে চলনবিলের গুরুদাসপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রাম, তাড়াশ, চাটমোহরসহ আরও অনেক উপজেলায়। বর্তমানে এই পদ্ধতিতে রসুন চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুনর রশীদ জানান, গুরুদাসপুর উপজেলার এ বছর ৫ হাজার ৩শ হেক্টর জমিতে রসুন রোপণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবিঘা জমিতে ২৫-৩০ মণ হারে রসুন উৎপাদন হয়। খরচ বাদ দিয়েও অনেক লাভবান হন কৃষকরা। কারণ একই জমিতে তরমুজ ও বাঙ্গি আবাদ করে। এ জন্য বিনাহালে রসুনের আবাদ করে চলনবিলের কৃষকরা।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, চলনবিলে গতবছর ২২ হাজার ৩শ হেক্টর জমিতে রসুন রোপণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে চলনবিলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রসুন চাষ করা হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ রসুন চাষ হয় চলনবিলের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, তাড়াশ, চাটমোহর ও সিংড়া বিলের কিছু অংশে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কৃষি পরামর্শ এবং সার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের মাঝে।