বাংলাদেশে আমরা সবাই শামছুজ্জোহা। কোন নিরীহ সাধারণ মানুষের গায়ে আঘাত লাগার আগে যেন আমার গায়ে আঘাত লাগে।
১. আমি সাধারণ মানুষ। তবে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শামছুজ্জোহা স্যারের আদর্শের সৈনিক। স্যারের একটি উক্তি ছিল কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে।
আজ ১৮ ফ্রেব্রয়ারি শহীদ জোহা দিবস।১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এভাবেই ছাত্রদের বাঁচাতে বুক টান করে নিজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। স্যারের ত্যাগে দেশ ও জাতি ঋণী। ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা এমনি একজন আজন্ম বিদ্রোহী। স্যারের আত্মোত্যাগের কারনেই উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত রচিত করেছিল। এই আত্মত্যাগ গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। ড. শামসুজ্জোহা, বাংলার প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা বাঙালির বীরত্বময় গৌরবগাথার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। স্যারের মৃত্যুর পরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে রুপ নিয়ে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটেছিল।
২.সেদিন যা ঘটেছিল…….
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণায় পাকিস্তানি সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মেইনগেটের সামনের মহাসড়কে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা মেইনগেটে ছুটে যান। প্রক্টর হিসেবে তিনি ছাত্রদের শান্ত করা এবং ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। ছাত্ররা পিছু হটতে না চাইলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হাদী ছাত্রদের গুলি করার নির্দেশ দেন।তখন ড. জোহা পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে’। এ সময় তিনি ‘ডোন্ট ফায়ার! ডোন্ট ফায়ার!’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। তিনি ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেন।কিন্তু প্রক্টরের আশ্বাসে কোনো কর্ণপাত না করে বেলা ১১টার সময় ক্যাপ্টেন হাদী তার পিস্তল বের করে ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। সেদিন মহান এই শিক্ষক ড. জোহার বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর মতিহারের নিষ্পাপ সবুজ চত্বর। হাসপাতালে নেওয়ার পর ড. জোহা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
প্রথমে ছাত্ররা বুঝতে পারছিলেন না, ড. জোহা ও তার সহকর্মীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে। দুপুর বারোটার দিকে ক্যাম্পাসে খবর আসে, ড. জোহাকে প্রথমে কাছ থেকে গুলি ও পরে বেয়নেট চার্জ করে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। এবং তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় রাজশাহী পৌরসভার একটি পুলিশ ভ্যানে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পড়ে আছেন। পরে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ড. জোহাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
খবর পেয়ে ছাত্র-জনতা ভিড় জমান হাসপাতালে। ইতোমধ্যেই অনেক দেরির কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটায় অপারেশন থিয়েটারে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন ড. দত্ত। অকাতরে প্রাণ দেন স্যার শহীদ শামছুজ্জোহা।
৩. আজ জোহা স্যার নেই। কিন্তু জোহা স্যার বাংলাদেশে লাখ লাখ আদর্শের সৈনিক তৈরি করে গেছেন। আমি মনে করি বন্দুকের সামনে দাঁড়ানো যেমন কঠিন অসহায় বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করা তার চেয়ে আরো অনেক কঠিন। বাংলাদেশে অনেক অনেক শামছুজ্জোহা আছেন। কয়েকজনের সম্পর্কে বলছি ধীরে ধীরে সবার সম্পর্কে বলব।
৪. আমাদের পিডি স্যার অতিরিক্ত সচিব ড. এ কে এম মুখলেছুর রহমান স্যার। আমি যখন বক্ষব্যাধী হাসপাতালে ভর্তি হই তখন আমার মনে হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার পরেই সৃষ্টিকর্তার দুত হিসেবে আমার পিডি স্যার এসেছিলেন। একদিনের মধ্যেই আমার শরীরের ফুসফুস থেকে ২ লিটার পানি বের করে এনেছিলেন ডাক্তার। আর এই কাজের জন্য সার্বিক কর্মকাণ্ড করেছেন আমাদের পিডি স্যার। আমি দেখি প্রতিদিন স্যারের ময়মনসিংহ এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ স্যারের কাছে বিভিন্ন ধরনের কাজে আসে। স্যার সকল সমস্যা সলভ করে দেন। একজন নির অহংকারী মানুষ আমাদের সকল সচিবদের মাঝে এক অনুকরণীয় মানুষ হিসেবে সবার হৃদয় জয় করে নিয়েছেন।
৫. শারমিনা সুলতানা এবং তার স্বামী আলী ভাইঃ শারমিনা ম্যাডামের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় মন্ত্রণালয়ের প্রবেশ পথে গাফফার স্যারের সাথে। ম্যাডাম লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গাফফার স্যার ম্যাডামের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ম্যাডাম সচিব স্যারের সাথে অফিসিয়াল কারনে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। আমি সেদিন ভীষণ অবাক হয়েছিলাম সচিব স্যারের দেখা করতে যাওয়া! এতো অনেক কঠিন। অফিসে চাকরি করছি। অফিসে যখনই বিপদে পড়েছি ম্যাডামের কাছে গিয়েছি। ম্যাডামের বুদ্ধি এবং প্রতিবাদের ভাষা আছে, মানবিকতা আছে। সব সমস্যার সমাধান করেছেন। একবার তো ব্রিটিশ কাউন্সিল এর পরীক্ষা পদ্ধতির বিপক্ষে কথা বলার কারনে ব্রিটিশ কাউন্সিল আমার বিরুদ্ধে বিরাট এলিগেশন দিয়েছিল। আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলের কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম একমাস আগে যে ব্যক্তি আই এল টি এস এ ৭.৫ পেল এবারের আইএলটি এ সে কিভাবে ৫.৫ পায়। আপনাদের পরীক্ষা সিস্টেম ভুল আছে। এই কথা বলার পর ব্রিটিশ কাউন্সিল এর মান সম্মানে আঘাত লাগে। পরে ব্রিটিশ কাউন্সিল আমার নামে বিশাল মিথ্যা অভিযোগ দেয়। ম্যাডাম পিডি স্যারকে প্রকৃত ঘটনা বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল এবং আমি বেচে গিয়েছিলাম। সেদিন মগবাজার দুর্ঘটনায় ম্যাডামের হাসবেন্ড আলী ভাই সারারাত আমার সাথে থেকে অনেক কস্ট করেছিলেন। আমাকে জুস খাওয়ানো। সারাক্ষন আমাকে ধরে রাখা। অনেক কাজ।
৬. আমাদের সোহেল স্যারঃ সোহেল স্যার ২৪ বিসিএস কর্মকর্তা। যখনই মন খারাপ হয় সোহেল স্যারের সাথে কথা বললে মনটা ভালো হয়ে যায় কারন সোহেল স্যার আমার সাথে সব সময় আমার পাবনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। সোহেল স্যার প্রায় মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন করে আমার নানা রকমের ভুলের কথা বলে। আমি রেগুলারই সোহেল স্যারের কাছে ক্ষমা চাই। আমি সোহেল স্যারকে কখনই বোঝাতে পারি নাই আমি স্যারকে অনেক পছন্দ করি। আমি বিপদে পড়ার মুহুর্তে প্রথমেই মনে হয়েছিল সোহেল স্যারকে ফোন করি। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ২ মিনিটের মধ্যে সোহেল স্যার মগবাজার পুলিশ বক্সে এসে ঐ মেয়ে দুটিকে বলেছিল এই মেয়ে তুই একে চিনিস। তুই কার সম্পর্কে কথা বলছিল তা জানিস! পুলিশের সামনেই ছেলেকে বলল তোকে থাপড়িয়ে দাত মুখ ভেঙ্গে ফেলব। সোহেল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে সবাইকে ফোন করেছিলেন। সোহেলের কারনেই তারা ধরা পড়েছিল। তাদেরকে পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে গিয়েছিল। লিখন, আই কে সেলিমুল্লাহ স্যার, রুপক, দিদার, মামুন স্যার, ফাতিহুল কাদির সম্রাট স্যার , ২৪ এর শফিকুল, কুতুব, কামাল, শওকত, আব্দুল হক, টিপু স্যার, জমিনসহ, আমার কলিগসহ বিভিন্ন বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা ও প্রিয় ছাত্র ছাত্রী ও আমার প্রিয় শুভাকাঙ্ক্ষীদের সম্পর্কে পর্যায়ক্রমে লিখব। আমরাই পারব, আমরাই জোহা স্যারের রক্তকে বৃথা যেতে দিব না।
বিদ্যুৎ কুমার রায়
সহযোগী অধ্যাপক, রসায়ন
প্রোগ্রাম অফিসার, টিচার ট্রেনিং
কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (সিইডিপি)
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা