প্রাথমিক শিক্ষা ভাবনা-পর্ব: ১

প্রাথমিক শিক্ষা ভাবনা- পর্ব: ১

—মো. রেজাউল করিম


সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৫৬৬ টি। এগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ৬১৭ জন।

তাদের শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষক মহোদয়ের সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫ জন। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শিক্ষাদানের জন্য যে শিক্ষকগণ রয়েছেন তারাও নির্বিঘ্নে শিক্ষাদানের সুযোগ পাচ্ছে না। তার বহুবিধ কারণ রয়েছে। যার অন্যতম কারণ হলো শিক্ষক সংখ্যা অপ্রতুল। বর্তমানে প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ছয়টি শ্রেণি রয়েছে। কোন কোন বিদ্যালয়ে প্রাক রয়েছে , তার উপরে কিছু সংখ্যক বিদ্যালয় রয়েছে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। অষ্টম শ্রেণীর বিদ্যালয়ের সংখ্যা নিতান্তই কয় বলে বাদই দিলাম।

লেখক-মো. রেজাউল করিম

ধরুন ,প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শ্রেণীর সংখ্যা ছয়টি। বেশিরভাগ বিদ্যালয় পাঁচটি শিক্ষক পদ রয়েছে। যেখানে শ্রেণীর সংখ্যা ছয়টি। পাঁচজন শিক্ষক দিয়ে একই সঙ্গে ছয়টি শ্রেণীতে পাঠদান সম্ভব হয় কী?

তারউপর কেউ মাতৃত্বকালীন ছুটিতে কেউ আবার ডিপিএড এর প্রশিক্ষণরত অবস্থায় অনুপস্থিত থাকে।

একটিবার চিন্তা করে দেখুন যে বিদ্যালয়ে চার থেকে পাঁচ জন শিক্ষক সেখান থেকে এক থেকে দুইজন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত সেখানে ছয়টি ক্লাস কিভাবে তিনজন শিক্ষকের দ্বারা পাঠদান সম্পন্ন হতে পারে??

বলবেন দুই শিফটে নিলেই তো হয়! প্রাক, প্রথম শ্রেণি এবং দ্বিতীয় ক্লাস তিনটি শিক্ষক তিনটি। কিন্তু শিক্ষক কেন বলছি তিনটি রোবট লাগবে তখন। বাংলাদেশে কি রোবটিক টিচার ভার্সন চালু হয়েছে??

সরকার বাহাদুর প্রতিবছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছেন। বাস্তবিক চাহিদার তুলনায় সেটা মোটেও বিপুল হতে পারেনি কোনদিনও। তার উপরে প্রধান শিক্ষকের পদ পূরণ হয়নি অনেক বিদ্যালয়ে।। প্রধান শিক্ষকের পদোন্নতি, চলতি দায়িত্ব , নন ক্যাডার নিয়োগ, শূন্য পদের অস্পষ্টতা নানাবিধ জটিলতায় প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থা নাজুক।।

এবার আসুন একটু উপরের দিকে নজর দেই 

প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমার দেখা কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আজ পর্যন্ত নিতে পারেনি যেটা বাস্তবিক প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী কোন ভূমিকা রাখতে পেরেছে।

হরহামেশা, খামখেয়ালি করে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তার সুফল পাওয়ার আগেই সে সকল প্রকল্প মেয়াদ পার হয়ে গেছে।।

প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে সচিব গুলো নিয়োগ দেয়া হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মেয়াদকাল দেখে মনে হয় অন্তর্বর্তীকালীন সময় তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।। কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস তাদের কার্যকাল থাকে এই মন্ত্রণালয়।।

মহাপরিচালক হিসেবে যারা অধিদপ্তরে এসেছিলেন তারাও খুব সামান্য সময়ের জন্য এখানে সময় কাটিয়ে গেছেন বললে অপরাধ হবে না।

এর মধ্যে রয়েছে প্রতিহিংসা পড়ায়নতা । কারণ একজন মহাপরিচালক যে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন পরবর্তীতে যিনি মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তার কাছ থেকে সে সকল সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনার কথা আর ঘুনাক্ষরেও শোনা যায় না। তার বিপরীতে তিনি হাজির হন নতুন নতুন পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে।

এভাবে রাজা যায় রাজা আসে কিন্তু প্রজাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না।

না শিক্ষার্থীদের কোন পরিবর্তন হয়, না শিক্ষকদের।

বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করে একটি বিষয়ে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত সত্যির মত দাঁড়িয়েছে। মাঠ পর্যায় যে কর্তা ব্যক্তিরা রয়েছেন তারাও বিদ্যালয়ের পাঠদান শিখন শেখানো কার্যক্রম উন্নয়নে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখতে পারেনি। কর্তা ব্যক্তিরা বিদ্যালয়ে আসেন ভিজিট করেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরামর্শ এমন কি কোন কোন সময় হুমকি-ধমকি কেউ দিতে দ্বিধা করেনা না। (ব্যতিক্রমদের জন্য সশ্রদ্ধ সালাম)

বিপরীতে আমার বক্তব্য, তারা হুট করে আসেন উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। এর বিপরীতে যদি তারা পুরো পাঠ দেখতেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে ফিডব্যাক দিতেন, নতুন কোন কৌশল অথবা পদ্ধতির সন্ধান এমন কি উপজেলা থেকে কোন পরিকল্পনা দিতেন সেটা ঢের বেশি ফলপ্রসূ হতো।

এবার আসুন প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু বলা যাক।

১৮৫৪ সালে উডের ডেপপ্যাচে সর্বপ্রথম শিক্ষক প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বিদ্যালয়সমূহের জন্য যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রয়োজন মেটাবার দিকেও ডেসপ্যাচ আলোকপাত করে।

সুশিক্ষা ও মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষক। শিক্ষকের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য একদিকে প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা, অন্যদিকে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। তাই চাহিদা ভিত্তিক যুগোপযোগী শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধন করা।

প্রশিক্ষণের ফলে যা হওয়া উচিত –

শিক্ষকদের শিখন-শিখানো কলাকৌশল সম্পর্কে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা।

· শিক্ষকদের পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধি করা এবং সময়ের সঙ্গে যুগোপযোগীকরণে সহায়তা দান।

· শিক্ষকদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব, উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি এবং নেতৃত্বের গুণাবলী জাগ্রত করা।

· শিক্ষণের জন্য আধুনিক উপকরণ ব্যবহার সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন ও ব্যবহারে উৎসাহিত করা।

· নতুন নতুন শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন এবং ব্যবহারে উৎসাহিত করা।

· সমাজের সকল ধর্ম, বর্ণ জাতিসত্ত্বা, আর্থ সামাজিক শ্রেণির শিক্ষার্থীকে সমান সুযোগ দিয়ে পাঠদানে উৎসাহিত করা।

· দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতন থেকে কার্য-সম্পাদনের জন্য শিক্ষকদের উৎসাহিত করা।

· গবেষণা কাজে অংশগ্রহণের জন্য আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি এবং উৎসাহিত করা। যার মধ্যদিয়ে বৃদ্ধি পাবে শিক্ষকদের মর্যাদা।।

বাস্তবিক যা ঘটেছে –

লালনের একটা গান এরকম : ‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা! বেদে নাই যার রূপরেখা ওরে, বেদে নাই যার…’। অনেক কাঠখড়ি পোড়ানোর পরই ধান খাবারের উপযুক্ত হয়। কোনো কিছুই সামান্যে পাওয়া যায় না। এ দেশের শিক্ষার গুণগত মান যে কোনো মূল্যে বজায় রাখতে হবে। বিদ্যালয় শিক্ষা যে পর্যায়ে নেমে গেছে, এখান থেকে সব শ্রেণির বিদ্যালয়ে একটা ন্যূনতম শিক্ষামানের ব্যবস্থা করে মোটামুটি সমপর্যায়ে আনার চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। একটা দশতলা বিল্ডিংকে ভেঙে বস্তির সমকক্ষ না বানিয়ে বস্তিটাকেই দশতলার কাছাকাছি উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। মোদ্দা কথা, দেশে শিক্ষার এ পর্যায় থেকে অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, এ বোধ আমাদের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি আসে, ততই মঙ্গল।

বিপত্তি ঘটে সেখানে যখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা কর্মস্থলে শিক্ষাদানে ব্রত হন। প্রশিক্ষণ শেষে সম্মানী আর ব্যাগ খানি ছাড়া কিছুই বহন করতে নারাজ।

একই সঙ্গে প্রশিক্ষিত শিক্ষকগণ শিখন শেখানো কাজে প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করছেন কিনা সেটা কখনো মনিটরিং করা হয় না। বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের নীতি নৈতিকতাও একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। যার প্রমান দেন শ্রেণি পাঠদানে। যেখানে বেশিরভাগ শিক্ষকেরই মাস শেষের দিনটি গুনতে ব্যস্ত থাকেন। এর ব্যতিক্রম নেই সেটাও দাবি করছি না। অনেক মহান এবং গুনি শিক্ষক এই বিভাগে রয়েছে যারা এখনো শিক্ষাদানের মহান ব্রত ধারণ করে শিক্ষাদান কে মহান পেশা হিসেবে বুকের মধ্যে লালন করেন।

এই গুটিকয়েক শিক্ষককে বাদ দিলে বাকিদের অবস্থা শুভঙ্করের ফাঁকির আধুনিক ভার্সন বলতে হয়।

 

মো. রেজাউল করিম

সহকারী শিক্ষক

বনপাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

বড়াইগ্রাম, নাটোর।

  • Online News

    Related Posts

    অনার্স-মাস্টার্স এমপিও ভুক্তির দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান

    বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশন, নাটোর জেলার পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক, নাটোর মহোদয়ের নিকট “এপ্লিকেশন টু দ্য চিফ অ্যাডভাইজার” স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। বেসরকারি কলেজ সমূহে নিয়োগপ্রাপ্ত অনার্স…

    কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করায় জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বহিষ্কার

    নাটোরে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে মোটরসাইকেল শোডাউন করা বিএনপি নেতা দাউদার মাহমুদকে সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করেছে দলটি। তিনি নাটোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সিংড়া উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব…

    You Missed

    অনার্স-মাস্টার্স এমপিও ভুক্তির দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান

    অনার্স-মাস্টার্স এমপিও ভুক্তির দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান

    কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করায় জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বহিষ্কার

    কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করায় জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বহিষ্কার

    ঘটনার ৭ বছরপর সাবেক এমপি পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে গুমের মামলা

    ঘটনার ৭ বছরপর সাবেক এমপি পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে গুমের মামলা
    প্রাথমিক শিক্ষা ভাবনা-পর্ব: ১

    টানা ৪র্থ বার উপজেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিম

    টানা ৪র্থ বার উপজেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিম

    ডাকাতের প্রস্তুতি কালে পুলিশের অভিযানে ৬ ডাকাত আটক

    ডাকাতের প্রস্তুতি কালে পুলিশের অভিযানে ৬ ডাকাত আটক