বড়দিনের ছোট ভাবনা
•••
প্রশান্ত চক্রবর্তী
আমরা,ভারতীয়রা,বিশেষত বাঙালি ও অসমিয়ারা ভীষণ সংস্কৃতিপ্রবণ জাতি। তাই বড়দিনের উৎসবে বাচ্চাদের সান্তাক্লজ সাজাই, নিজেরা গির্জায় যাই। গিয়ে সেল্ফি তুলি। আমাদের কিছু একটা পেলেই হল। সেটাকে উৎসবে পরিণত করি আমরা। মৃত্যুশোক কাটিয়ে শ্রাদ্ধটাও আমাদের কাছে ভোজে রূপান্তরিত। মৎস্যমুখ, শাকস্পর্শ…। নতুন ধান উঠলে নবান্ন, আলোর উৎসব দীপাবলি, রঙের উৎসব হোলি বা দোল, নতুন বছর…বিহু, দুর্গাপূজা, নববর্ষ…রথ…ঝুলন… সরস্বতী পূজা…হ্যানাত্যানা কত কী…। এ ছাড়া, পারিবারিক পূজাপার্বণ অনুষ্ঠান তো লেগেই আছে। ভাইফোঁটা, জামাইষষ্ঠী, অন্নপ্রাশন বা মুখে ভাত…। লোকউৎসবের সীমাসংখ্যা নেই। চড়ক-গাজন, তিননাথের সেবা, অষ্টপ্রহর থেকে বাহান্ন-চুয়ান্ন ঘণ্টা কীর্তন, যাত্রা, পালাগান…। অসমিয়া সমাজেও অজস্র অনুষ্ঠান উৎসব। কিছু একটা পেলেই হল। আমাদের আর পায় কে? দে ঝাঁপ।
গুয়াহাটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে তিন-তিনটি গির্জা। উত্তরপূর্বের সবচেয়ে প্রাচীন গির্জাগুলো এখানে। ১৮৪৫-৪৬ এরকম সময়ের। তারপাশে ডনবস্কো স্কুল ও গির্জা। ফেন্সিবাজার সংলগ্ন পানবাজারে নদীর ধারে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের গির্জা। আর, আমাদের কটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক উল্টোদিকে নেহরু পার্ক(কেন সর্বত্র নেহরু ও নকল গান্ধিদের নামে রাস্তা থেকে স্টেডিয়াম, এয়ারপোর্ট সব হবে?)-এর পেটের ভেতর সবচেয়ে পুরনো গির্জাটি। সমাগত বড়দিন, গোটা পানবাজারে বিকেল থেকেই হাজার হাজার মানুষ পিলপিল করে ঢুকবে এই গির্জাগুলোয়। আমিও একসময় ঢুকেছি। ভগবান বুদ্ধ ও প্রভু জিশুর জীবন আমাকে বরাবরই টানে। জিশু যে কাশ্মীরে এসে ভারতীয় যোগ সাধনা শিখে গেছেন, সেটা সাহেবেরাই লিখেছেন। বড়দিনে একসময় উৎসব দেখতে গাড়ি চালিয়ে মেঘালয়েও চলে যেতাম। কিন্তু যতদিন গেছে, তত নতুন কথা ভেবেছি। আবেগতাড়িত ভারতীয়, বাঙালি বা উত্তরপূর্বের মানুষ রূপে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছি। কিন্তু গভীরভাবে তখনও কিছু কথা ভেবে দেখিনি।
এই যে বড়দিনে গির্জায় হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমাচ্ছে, এদের সিংহভাগই কিন্তু হিন্দু। মূলত বাঙালি ও অসমিয়া। আমরা উৎসব ভালোবাসি বলেই এই যাওয়া। লক্ষ করুন, এখন বিহারিদের ছট পূজাতেও অজস্র বাঙালি নদীর ধারে যায়। মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর হুজুগ মারাত্মক বেড়েছে। ছবি তোলার মৌকা চাই তো। আর বড়দিনের সুবিধাটুকু হল, সামনেই ইংরেজি নববর্ষ থাকে। গোটা বিশ্বের জীবন চলে ইংরেজি মতে। তাই একত্রিশ ডিসেম্বর বা পয়লা জানুয়ারি এখন মানুষের জীবনে অন্যতম উৎসব। ছিল খ্রিস্টানদের, হয়ে গেছে সকলের।
উৎসবের এই বিস্তার তো লোকজীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে জাতি ও ধর্মগতভাবেও উৎসবের সীমাবদ্ধতা থাকে। আপনি মন্দিরে, গির্জায় যত খুশি যেতে পারেন, কিন্তু মসজিদ সবার জন্যে অবারিত দ্বার নয়। তাই ইসলামি পরবে অমুসলমানদের অংশগ্রহণ অবাধ নয়।
মিশনারি শব্দটির মধ্যে একটা “মিশন” লুকিয়ে আছে। সেই মিশনটা হল, খ্রিস্টানি বাড়াও। ওরা উত্তরপূর্বের পাহাড়েকন্দরে ঢুকে গেছিল নিজেদের শাসকদের সাথে তলায় তলায়। ওই একটাই মিশন। নিজেদের ধর্মরাজ্য বাড়াও। পাদ্রিরা সেই মিশনেই কাজ করেছে। সামনে সেবা, অন্তরালে “মিশন”। ভাবধারার প্রচার, বিস্তার, ধর্মান্তরকরণ। এরা জুলুমে যায়নি। দিয়েছিল লোভ। অর্থ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন। উত্তরপূর্বের পাহাড়িয়া আদিম মঙ্গোলীয় অস্ট্রিক ভোটচিনা মানুষ ইউরোপীয় সভ্যতার আলোকে নিজেদের আত্মপরিচয় গড়ে তুলেছিল। সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারের ধর্মজীবন সমগ্র উত্তরপূর্বের পাহাড়গুলোকে ক্রমশ গ্রাস করেছে। ব্রাহ্মরা চেষ্টা করেছিল এই প্লাবন ঠেকানোর। পারেনি। কলকাতা থেকে ব্রাহ্মপ্রচারক নীলমণি চক্রবর্তী মেঘালয়ে জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়ে গেলেন। কাজ হয়নি তেমন। মণিপুরে কৃষ্ণসংস্কৃতির শেকড় গভীর, তাই বাঁচোয়া। আসলে শাসকের সঙ্গে ধর্মবিস্তারের বিরাট একটা যোগশাজস রয়েছে। ভারতে ইসলামও এসেছিল এক হাতে তরবারি, অন্য হাতে কোরান নিয়ে। হয় ইসলাম নাও, নইলে মরো। মিশনারিরা জোরজুলুম করে ধর্মান্তর করার পথটি নেয়নি। আধুনিক চিকিৎসা আর শিক্ষা ছিল ওদের মানুষ ধরার মূল কৌশল। তার পাশাপাশি নানা প্রলোভন। ছিল বুজরুকিও। ইংরেজি শিক্ষা আর আধুনিক হাসপাতাল স্থাপন সত্যিই কাজে লেগেছিল। মনুষ্যসেবা কিন্তু সবচেয়ে ধর্মপন্থা। মানুষের চিত্তজয়ের প্রকৃষ্ট পন্থা। পাশাপাশি যাজন। পাদ্রিরা খুব ভালো যাজন করতে জানে। রবীন্দ্রনাথ একবার ইউরোপ যাচ্ছেন জাহাজে। এক পাদ্রি কবির পেছনে জোঁকের মতো লেগে গেল, তাঁকে খ্রিস্টান করেই ছাড়বে। অত সহজ? যাঁর মনোগঠনে হাজার হাজার বছরের আর্য সভ্যতা রয়েছে, তাঁর ধর্ম পাল্টানো মামুলি পাদ্রির কর্ম নয়। উত্তরপূর্বে এখনও খ্রিস্টান করার নানা উৎপাত আছে।
আমার পন্থাই শ্রেষ্ঠ, বাকি সব নিকৃষ্ট–এই ধারণাই মৌলবাদ। এতে মিশনারি, শরিয়তি, বামপন্থী সব একাকার। এরা মনে করে তাদের পথই শেষ কথা। উল্টোদিকে ভারতীয় সভ্যতা বলে, যত মত তত পথ। বসুধৈব কুটুম্বকম। আমাদের দেশ মুক্তচিন্তার দেশ। এখানে চার্বাক সাংখ্য নাস্তিক আস্তিক সব মার্গই ছিল। আপনি নাস্তিক হলেও ক্ষতি নেই। কেউ আপনাকে খুন করবে না, বাড়ি গিয়ে আগুন দেবে না। আমাদের সভ্যতা সমস্ত মত-পন্থাকেই একেকটি অনুশীলনপদ্ধতি বলে মানে। শৈব শাক্ত গাণপত্য সৌর…সব আছে। সামান্য বিরোধ খটাখটি ছিল, সংঘাতও হয়েছে, কিন্তু অবশেষে, মহামানবের সাগরতীরে সব মিলিয়ে মহান সভ্যতা।
রবীন্দ্রনাথ নিজে জিশুর পরম অনুরাগী ছিলেন। হিংসার পৃথিবীতে জিশুর জীবন যে প্রেমের শাশ্বত বাণী বহন করে চলেছে, সেই কথা কবি বলে গেছেন। কবিতায়, রচনায়। বহু ভারতীয় মানুষ জিশুকে ঈশ্বরপুত্র বলে মানে।
কিন্তু মিশনারি আগ্রাসন তো কাম্য নয়। আর স্কুলে স্কুলে ভূত সাজতে হবে ছেলেপুলেদের, টুনিলাইট লাগিয়ে ক্রিসমাস ট্রি বসাতে হবে ড্রয়িং রুমে, কিংবা কেক কেটে হ্যাপি বার্থ ডে উদযাপন করতে হবে? কোথায় গেল মায়ের হাতে জন্মদিনের পায়েশ, গুরুজনদের প্রণাম? কোথায় গেল নববর্ষের দিনে পাত পেড়ে খাওয়া? ঘরে ঘরে এমন এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা স্কুলে তো বটেই বাইরেও নিজেদের মধ্যে হিন্দি-ইংরেজিতে কথা বলে। এবং মনে করে এটাই সভ্যতা। নতুন প্রজন্মের কয়টি ছেলেপুলে বাংলা বা অসমিয়া কোন মাস চলছে, জানে? আমাদের ঘরোয়া জীবন এক বিজাতীয় কালচারে ভরে গেছে। আমাদের অজান্তেই আমরা এখনও বিদেশীদের দাসত্ব করছি।
সেন্ট মেরিজ বা ডনবস্কো স্কুলগুলোতে এক সময় সরস্বতী পূজা করতে দেওয়া হতো না। এখনও বহু জায়গায় অনুমতি দেয় না। তবে ছাত্রছাত্রী কমবে, জনরোষ বাড়বে এইসব আশঙ্কায় এখন কিছু কিছু ভারতীয় সংস্কৃতি পালন করার অনুমতি দিচ্ছে এরা। রবীন্দ্রজয়ন্তী, নেতাজি জয়ন্তী বা শংকরদেবের তিথি তো কল্পনাও করা যায় না।
বড়দিনে গির্জায় যাওয়া অপরাধ নয়, আনন্দের। সংস্কৃতি ও উৎসবের। এইটুকু অবকাশ তো কারও ক্ষতি করছে না। কিন্তু আমাদের কীর্তনের আসরে, মন্দিরে, বিহুতে, পূজার মেলায় কতজন খ্রিস্টান যোগ দেয় বলুন তো?