যে কাহিনি অনুকরনীয় এবং সিনেমাকেও হার মানায়
………বিদ্যুৎ কুমার রায়
১. ঠিক কোথা থেকে শুরু করব তা বুঝতে পারছি না। তবে আমরা সবাই একটা বিষয় জানি সেটা হলো সাধারণত সিনেমাতে নায়ক চরিত্র তৈরি করা হয় কোন উন্নত চিন্তাশীল ভালো মানুষের কর্মকান্ড যেন সবার মাঝে প্রবাহিত হতে পারে। পরিচালক সর্বোচ্চ চিন্তা করে সর্বোচ্চ আদর্শের চরিত্র দিয়ে নায়ক চরিত্র তৈরি করে। আমাদের আশেপাশের কত যে অনুকরণীয় ঘটনা ঘটে চলছে তার খোজ আমরা কয়জনই বা রাখি। আজ আমি মোঃ আব্দুল আউয়াল ভাইয়ের একটি অনুকরনীয় ঘটনা উপস্থাপন করব।
২. আব্দুল আউয়াল ভাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। সেই ২০১৪ সাল থেকে আমার সাথে পরিচয়। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পেনশন রিলেটেড একটা কাজে গিয়েছিলাম। আউয়াল ভাইয়ের সাথে সেদিনই প্রথম দেখা। আমাকে প্রথম দিনই দুপুরের লাঞ্চ করাইল আউয়াল ভাই তার নিজের রুমে। আমি তো অবাক! মন্ত্রণালয়ের কোন কর্মকর্তার সাথে প্রথম সাক্ষাতে এরকম আতথিয়তায় আমি ভীষণ মুগ্ধ হলাম। তারপরে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। আমি অসুস্থ হলে আওয়াল ভাই এবং ভাবি অনেক খাবার নিয়ে দেখতে এসেছে। আমি মাঝে মাঝে আওয়াল ভাইয়ের বাসায় যাই আমার অফিসিয়াল এবং ব্যক্তিগত কাজে। আওয়াল ভাইও আমার মত দেশের পড়াশোনা নিয়ে, গাইড কোচিং নিয়ে, দেশের গরীব অসহায় মানুষদের নিয়ে সব সময় ভাবেন। এজন্য আমার সাথে আওয়াল ভাইয়ের সম্পর্কটা একটু বেশিই গভীর।
৩. মিরপুরের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ভিতরের এক সরকারি বাসায় আওয়াল ভাই থাকত। আমি প্রায়ই সেখানে যেতাম। আমরা সচরাচর জানি যে সবাই বলে পর কখনো আপন হয় না। দেশে প্রচলিত এই বাক্য আওয়াল ভাই এবং ভাবি বিশ্বাস করতো না। তাদের কথা রক্তের সম্পর্ক হলেই যে মানুষ আপন হয় তা কিন্তু না। রক্তের সম্পর্কের বাহিরেও আত্মার সম্পর্কেও মানুষ আপন হয়। এবার আসল কথায় আসি। আওয়াল ভাইয়ের দুইটা মেয়ে। আওয়াল ভাইয়ের ওয়াইফ মানে ভাবির বোনের একটা মেয়ে। ভাবির বোনের মেয়ে জন্ম দেওয়ার পরে মারা যায়। ভাবী সেই মেয়েকে তার নিজের কাছে এনে মানুষ করে। আওয়াল ভাইয়ের বড় মেয়ের সমবয়সী সেই মেয়ে। আওয়াল ভাইয়ের বাসায় আমি যাওয়ার অনেকদিন বুঝি নাই যে একটা মেয়ে ভাবির বোনের মেয়ে। অনেক দিন পর আমি ঘটনাটা জেনেছি।
৪. আমি সাধারণত ফোন না করেই আওয়াল ভাইয়ের বাসায় যেতাম। কারন আমি মনে করি ফোন করলে আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাদের কাজের বিঘ্ন ঘটবে। গতকাল আমি ফোন না করে তাদের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ভিতরের কোয়ার্টারের বাসায় যাই। দেখি বাসা চেঞ্জ। আমি ফোন করি। নতুন বাসায় তারা উঠেছেন। এই বাসাটা আর ভাড়া না। এটা তাদের নিজের বাসা। বাসাটা অল্প একটু দূরে। আমি ঠিকানা নিয়ে সেই বাসায় গেলাম। আওয়াল ভাইয়ের নতুন বাসায় যেয়ে আমার দীর্ঘদিনের সব চিন্তা ভুল হয়ে গেল। আমি ভাবতাম যে ভাবীর বোনের মেয়েকে তারা লালন পালন করেছে। সেই বোনের মেয়ে তাদের বড় মেয়ের সাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই সাবজেক্টে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়তেছে। এইটুকই ভাবতাম। কিন্তু আওয়াল ভাই এবং ভাবি যে তাদের সমগ্র জায়গা জমি তাদের দুই মেয়ের মত তাদের বোনের মেয়েকেও সমান ভাবে বন্টন করে দিবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আওয়াল ভাই যে বাসাটা তৈরি করেছেন তাতে চারটি রুম। আওয়াল ভাইয়ের জন্য একটা এবং তিন মেয়ের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রুম। তিন মেয়ে তাদের পছন্দমতো রুমের ইন্টেরিয়র করেছে। যে কেউ আওয়াল ভাইয়ের বাসায় যেয়ে মুগ্ধ হয়ে যাবে। আওয়াল ভাই এবং ভাবি কোনদিন এই মেয়েকে তাদের বোনের মেয়ে হিসেবে কল্পনা করে নাই। সব সময় নিজের মেয়েই মনে করেছেন। ভাই এবং ভাবি পরিবারের সবার মধ্যে বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে সব সময় সুষম বন্টন করে থাকেন। বাংলাদেশে অন্য কোন পরিবারে এরকম সম্পদের বন্টন আমি দেখি নাই। আমার কাছে এই ঘটনা একটা যুগান্তকারী এবং অনুকরণীয়।
বিদ্যুৎ কুমার রায়
২২ তম বিসিএস সাধারন শিক্ষা কর্মকর্তা, সহযোগি অধ্যাপক, রসায়ন, প্রোগ্রাম অফিসার, টিচার ট্রেনিং, কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট, শিক্ষা মন্ত্রনালয়, ঢাকা।