চঞ্চল চৌধুরীর ধর্ম পরিচয় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য: ওপার বাংলায়ও নিন্দার ঝড়

 

বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী মা দিবসে তার মাকে নিয়ে ছবি পোস্ট করার পর তাঁর ধর্ম পরিচয় নিয়ে বাংলাদেশী উগ্র মৌলবাদীদের দ্বারা যে সাইবার হামলার শিকার হয়েছেন সেটা নিয়ে এবার সরব হয়েছেন ভারতের কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক ড. প্রশান্ত চক্রবর্তী। তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে এ বিষয়ে বিশদ একটি লেখা পোস্ট করেছেন। আবেগ, হতাশা ও ক্ষোভময় সেই পোষ্টটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশের অতি জয়প্রিয় গায়ক-নায়ক অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। আমি তাঁর অনুরাগী ভক্ত। আমার প্রয়াত বন্ধু কালিকাপ্রসাদের মুখে আমি তাঁর কথা প্রথম শুনি। এবং “মনের মানুষ” সিনেমায় প্রসেনজিতের সহশিল্পী হিসেবে তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হই। এরপর “সাকিন সারিসুরি”, “তিন গেদা”, “হাড় কিপ্টা” টেলি ড্রামা থেকে “মনপুরা” ইত্যাদি সিনেমায় তাঁর অভিনয় দেখে আমার পাগল-পাগল দশা। ইউটিউবে তাঁর যা যা নাটক সিনেমা আছে~প্রায় সব কয়টাই দেখেছি। কোনো কোনোটা বহুবার।

একসময় তাঁর সাথে মেসেনজারে আমার যোগাযোগ হয়। এখন তিনি আমার বন্ধু তালিকায় আছেন। আমি ধন্য। মাঝে মাঝে কথাও হয়। তিনি আমাকে দাদা সম্বোধন করায় আমি মুগ্ধ, আপ্লুত। এ আমার পরম পাওয়া।

তাঁর গুণমুগ্ধ এখন সারা পৃথিবীতে ভরা।

•••

বাংলাদেশের এমন মহান অভিনেতা সম্প্রতি মাতৃদিবসে তাঁর মায়ের সাথে নিজের একটি ছবি পোস্ট করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই ছবিটি আমারও খুব প্রিয়। আমি নিজে আমার মায়ের সাথে থাকা ছবি প্রোফাইলে রেখেছি। “মা”–জগতের সবচেয়ে পবিত্র একটি শব্দ। আমার গুরুর একটি বাণী স্মরণ করি~”মাতৃভক্তি অটুট যত, সেই ছেলে হয় কৃতী তত।” পৃথিবীতে মহান সফল মানুষদের জীবন লক্ষ করুন, দেখবেন~বেশির ভাগ কৃতী মানুষের জীবনের মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। এটা যেমন দার্শনিকভাবে সত্য, তেমনি বিজ্ঞানসম্মতভাবেও। বিদ্যাসাগর থেকে বিবেকানন্দ, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে চঞ্চল চৌধুরী~সবার জীবনেই এর প্রতিফলন।

চঞ্চলবাবুর মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর দেখার পর বাংলাদেশের মোল্লাবাদী ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের একাংশ চটে লাল। এদের অনেকে চঞ্চলবাবু যে “হিন্দু” সেটা জানত না। সেটাও বলেছে। যেন, হিন্দু হওয়া অপরাধ। হ্যাঁ, বাংলাদেশে তো অপরাধই। নইলে “শত্রুসম্পত্তি আইন” থাকে?! হিন্দুরা “শত্রু” বলে গণ্য হওয়ার ফলেই তো ওইরকম নামকরণ করা হয়েছিল। ভাগ্যিশ “গণিমতের মাল” বলেনি।

চঞ্চল ও চৌধুরী~দুটো নাম-পদবি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পাওয়া যায়। তাই ধর্মান্ধ মোল্লার বাচ্চাগুলো ধরে নিয়েছিল তিনি মুসলিম। মায়ের ছবিতে সিঁদুর দেখেই এরা আঁতকে উঠেছে। আরে~এ দেখি মালাউন, কাফের। একে এতদিন আমাদের লোক বলে ভেবেছি?! তৌবা তৌবা। নাউজুবিল্লাহ।

তার মানে~চঞ্চল চৌধুরী বাঙালি নন, তিনি হিন্দু। আর ওরাও বাঙালি নয়~ওরা মুসলমান।

কাজি নজরুলকে সামনাসামনি পেলে বলতাম~ একই বৃন্তে দুটি কুসুম ফোটেনি প্রিয় কবি। আমরা চিরদিন “মালাউন” আর “কাফের” হয়েই থেকে গেলাম! কে যেন প্যারডি করে মনের দুঃখে লিখেছে~”একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান” যদি হয়ই~তাহলে~”দেশটা কেন

ভাগ হলো, গড়ল পাকিস্তান?” এই প্রশ্নের উত্তর গভীর এবং জানা।

সব চেয়ে দুঃখের কথা~চঞ্চলবাবুকে যাঁরা হিন্দু চিহ্নিত করে মুসলমানি দেখাচ্ছে~তাদের ৯৯ শতাংশেরই পূর্বপুরুষ ছিল হিন্দু। আজ যেটা বাংলাদেশ বলে চিহ্নিত~সেটা তো,এই সেদিনও হানাদার বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের আগেও পুরোটাই হিন্দু রাজত্ব ছিল। বিশ্বাস না হলে~বাংলাদেশেরই প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী পণ্ডিত গোলাম মুরশিদের “হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস”(প্রকাশক : অবসর, ঢাকা) পড়লেই হয়।

একজন অভিনেতার ধর্ম পরিচয় কি জরুরি?! মোল্লাদের মতে জরুরি। একটি ধর্মান্ধ তো দাবিই করেছে~ইসলামই শ্রেষ্ঠ ও হিন্দুরা নিকৃষ্ট। এসব ওদের দোষ নয়~দোষ হাসিনা সরকারেরও। ইসলামের নামে ওখানে ওয়াজ মেহফিলে যা হয়~পৃথিবীর কোনো মুসসিম দেশে হয় বলে তো মনে হয় না। একাংশ মাদ্রাসা নামক ধর্মান্ধ প্রোডাকশনের কারখানায় এরচেয়ে বেশি চিন্তা উৎপাদন হবে কী করে?!

চঞ্চলবাবুর অসামান্য কাজগুলো~অভিনয়, গান, ছবি~শিল্পের নানা উজ্জ্বল সৃষ্টিগুলোর বিচার শরিয়ত দিয়ে করতে হবে?! শরিয়তে তো সংগীত ও ক্রীড়াও নিষিদ্ধ। তাহলে শরিয়তি রাষ্ট্রে টিভি মোবাইল সিনেমা এসব চলে কী করে?

মাইকেল মধুসূদনকে আমরা কি খ্রিষ্টান কবি ভাবি?! মেঘনাদবধ পড়ার সময় বাইবেল মনে আসে?! কাজি নজরুলকে পড়ার সময় বা শোনার সময় কি আমরা কোরান হাদিস সামনে রেখে পড়তে হয়?! মুসলমান কবি ভাবি?! মনে পড়ে~নজরুলের অসংখ্য শ্যামাসংগীত ও কৃষ্ণগীতি দেখে এদেরই পূর্বজরা তাঁকে “কাফের” বলত!

তবে, সুখের কথা, চঞ্চলবাবুর ওপর এই মানসিক আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অসংখ্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম মানুষ প্রতিবাদ করেছেন। কটুক্তি করা লোকের সংখ্যা তার তুলনায় কম। কিন্তু তাও এই ধর্মান্ধরাই ওখানে সংখ্যাগুরু।

চঞ্চলবাবু ঠিকই বলেছেন~ওই দেশে হিন্দুরা মোটেও সংখ্যালঘু নয়~আসলে সংখ্যালঘু হলো মুক্তচিন্তার মানুষগুলো।

আমার সাহিত্যগুরু সৈয়দ মুজতবা আলী দেশভাগের পরও স্ত্রীপুত্র পরিবার আত্মীয়স্বজন ফেলে ভারতেই থেকে গেলেন। এখন ভাবি~”মুসলমানের দেশ” হওয়ার পরও কেন সেখানে পাকাপাকি যাননি। বলতেন~”আমাকে একটি শান্তিনিকেতন, একজন রবীন্দ্রনাথ আর একখানা ন্যাশনাল লাইব্রেরি দাও~আমি স্থায়ীভাবে ঢাকা যেতে রাজি আছি।”

ঠিকই~বাংলাদেশ আজও লালন ফকির, শাহ আবদুল করিম, আসগর আলী, হাসন রাজা, ভানু শেখ, জসিমুদ্দিন, রেজাউল করিম, ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বা মুজতবা আলীর আগাপাশতলা বাঙালিদেশ হতে পারেনি।

চঞ্চলবাবু~আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। অখণ্ড বাঙালিভুবন আপনার কষ্টের সমব্যথী…! কয়েকজন বলেছে~মানি~কিন্তু ঋষি বঙ্কিমের কথাটাও তো ভুলতে পারিনি~”কণ্টক যতই ক্ষুদ্র হোক, তাহার বিদ্ধ করিবার ক্ষমতা আছে।”

••••

গুণমুগ্ধ~

ড. প্রশান্ত চক্রবর্তী

বিভাগীয় প্রধান

বাংলা বিভাগ

কটন বিশ্ববিদ্যালয়

গুয়াহাটি

অসম

১১-৫-২১

  • Online News

    Related Posts

    অনার্স-মাস্টার্স এমপিও ভুক্তির দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান

    বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশন, নাটোর জেলার পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক, নাটোর মহোদয়ের নিকট “এপ্লিকেশন টু দ্য চিফ অ্যাডভাইজার” স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। বেসরকারি কলেজ সমূহে নিয়োগপ্রাপ্ত অনার্স…

    কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করায় জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বহিষ্কার

    নাটোরে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে মোটরসাইকেল শোডাউন করা বিএনপি নেতা দাউদার মাহমুদকে সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করেছে দলটি। তিনি নাটোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সিংড়া উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব…

    You Missed

    অনার্স-মাস্টার্স এমপিও ভুক্তির দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান

    অনার্স-মাস্টার্স এমপিও ভুক্তির দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান

    কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করায় জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বহিষ্কার

    কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করায় জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বহিষ্কার

    ঘটনার ৭ বছরপর সাবেক এমপি পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে গুমের মামলা

    ঘটনার ৭ বছরপর সাবেক এমপি পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে গুমের মামলা
    প্রাথমিক শিক্ষা ভাবনা-পর্ব: ১

    টানা ৪র্থ বার উপজেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিম

    টানা ৪র্থ বার উপজেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিম

    ডাকাতের প্রস্তুতি কালে পুলিশের অভিযানে ৬ ডাকাত আটক

    ডাকাতের প্রস্তুতি কালে পুলিশের অভিযানে ৬ ডাকাত আটক