ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মোবাইল ফোনের গ্রাহকরা বিটিআরসির অনুসন্ধানে মিলেছে ভয়াবহ চিত্র
গ্রাহকদের অজান্তেই তাদের মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস চালু করে টাকা লুটে নেওয়া হচ্ছে। নিউজ এলার্ট, ওয়েলকাম টিউনসহ এমন নানা ধরনের সেবার নামে এ টাকা কেটে নিচ্ছে এক শ্রেণির ভ্যাস (ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস) প্রোভাইডার। মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি থেকে লাইসেন্স পাওয়া পর এসব ভ্যাস প্রতিষ্ঠান মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে যুুক্ত হয়। এই সেবাগুলো থেকে প্রাপ্ত অর্থের অংশ মোবাইল অপারেটর, সরকার ও ভ্যাস প্রতিষ্ঠানগুলো পেয়ে থাকে। মোবাইল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত শতাধিক ভ্যাস প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের ছয় মাসের কার্যক্রম অনুসন্ধান করেছে বিটিআরসি। সেখানে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। একটি প্রতিষ্ঠান গত আগস্ট মাসে সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি গ্রাহকের মোবাইলে বিভিন্ন ধরনের সেবা চালু করেছে। বিটিআরসির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই সার্ভিসগুলো চালুর আগে একজন গ্রাহকের কাছ থেকেও তারা সম্মতি নেয়নি। অথচ এই গ্রাহকদের অজান্তেই তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক ইত্তেফাককে বলেন, ‘এই ধরনের চুরি বন্ধের জন্য বিটিআরসি সব সময় তত্পর রয়েছে। আমরা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারেও অনুসন্ধান শুরু করব। যাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগের সত্যতা মিলবে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা ইতিমধ্যে অভিযুক্ত দুই প্রতিষ্ঠানের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে মোবাইল অপারেটরদের নির্দেশ দিয়েছি।’
বিটিআরসির ২৪৪তম সভায় ভ্যাস প্রোভাইডারদের এই অপকর্ম নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। সেখানে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ ফেরত এনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার পক্ষে অনেকে মত দিয়েছেন। পাশাপাশি এই অবৈধ উপার্জনের যে অংশ মোবাইল অপারেটররা পেয়েছেন তাদের কাছ থেকেও অর্থ ফেরত আনতে হবে। বৈঠকে ভ্যাস প্রোভাইডারদের এই অপকর্মের জন্য মোবাইল অপারেটরদের দায়ী করে বলা হয়েছে, মোবাইল কোম্পানিগুলো চাইলে এভাবে গ্রাহকের অজান্তে তারা টাকা কেটে নিতে পারত না। তারা কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না। বরং তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এই টাকা কেটে নেওয়াকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করে প্রশাসনিক জরিমানা করার পক্ষেও মত দিয়েছেন অনেকে।
সক্রিয় শতাধিক ভ্যাস প্রোভাইডারের মধ্যে ‘পার্পল ডিজিট কমিউনিশেন লিমিটেড’ ও ‘দ্য অভিকথাচিত্র লিমিটেড’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের গত ছয় মাসের কার্যক্রম অনুসন্ধান করে বিটিআরসি। সেখানে দেখা গেছে, গত আগস্ট মাসে অভিকথাচিত্র ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭২২ জন গ্রাহকের ফোনে ‘ডেইলি নিউজউড২৪’ এর নিউজ এলার্ট ও ‘ঝালমুড়ি ওয়েব পোর্টাল’ সার্ভিস চালু করেছে। এই গ্রাহকদের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বিটিআরসি ৯০ জন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলেছে। ৪২ জনই বলেছেন তাদের কাছ থেকে কোনো সম্মতি নেওয়া হয়নি। ১৭ জন ফোন ধরেননি, আর ৩১ জনের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। একজনও বলেননি, তাদের সম্মতি নিয়ে এই সার্ভিসটা চালু করা হয়েছে। অভিকথাচিত্র শুধু নিউজ এলার্ট দিয়েই ওই মাসে ৪৩ লাখ টাকা আয় করেছে। এর মধ্যে মোবাইল ফোন অপারেটররা পেয়েছে ২৬ লাখ টাকা আর অভিকথাচিত্র পেয়েছে ১৭ লাখ টাকা। বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিস বিভাগের কর্মকর্তারা এই অনুসন্ধান করেন।
একইভাবে পার্পল ডিজিট গত এপ্রিল মাস থেকে ৭৬ হাজার ৮৬০ জন গ্রাহককে দুটি ভ্যাস সার্ভিস দিয়েছে। এর মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ১০০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে বিটিআরসি। এর মধ্যে ১৭ জন বলেছেন তাদের সম্মতি নিয়েই এটা চালু করেছে। ৪৬ জন বলেছেন তাদের সম্মতি নেওয়া হয়নি। ২৬ জন ফোন ধরেননি, আর ১১ জনের নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। বিটিআরসির কাছে পার্পল ডিজিট স্বীকার করেছে, তারা ‘ইকরা’ সার্ভিস চালু করে গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় করেছে। গ্রাহকদের সম্মতি না নিয়েই এটা তারা করেছে।
জানা গেছে, বিটিআরসির কমিশন বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে এদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটরদের ভ্যাস সার্ভিস বন্ধ রাখারও সুপারিশ করা হয়েছে। এভাবে গ্রাহকদের ঠকানো প্রতারণার শামিল বলে মনে করে বিটিআরসি। জানা গেছে, এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সংযোগ ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন।
এ ব্যাপারে মোবাইল অপারেটর রবির হেড অব রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম ইত্তেফাককে বলেন, ‘ভ্যাস প্রোভাইডারদের লাইসেন্স দেয় বিটিআরসি। তাদের জবাবহিদিতাও বিটিআরসির কাছে। বিটিআরসি লাইসেন্স দেওয়ার পর আমরা তাদের সংযোগ দিতে বাধ্য। তাদের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের সুযোগও নেই আমাদের। ফলে তাদের অপরাধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। আমরা সার্ভিস দিয়েছি, এর জন্য টাকা পেয়েছি। তারা গ্রাহকের সম্মতি নিয়ে এই সেবাটি চালু করেছেন, নাকি সম্মতি না নিয়ে করেছেন এটা আমাদের জানার কোনো সুযোগ নেই।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমানও ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে একই কথা বলেছেন। তার মতে, ‘অন্যের অপরাধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
সুত্র : দৈনিক ইত্তেফাক