সাধু আন্তনির পালা
ধন্য তুমি, পূণ্য তুমি আন্তনি, মহাজ্ঞানী, মহাত্যাগী সাধু আন্তনি’র বন্দনার মধ্য দিয়ে উক্ত গানের ভূমিকা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে সাধু আন্তনি নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয় ৷ মূলত খ্রিষ্টীয় সন্ন্যাসজীবনের সূচনা তৃতীয় শতাব্দীর শেষ দিকে, বিশেষভাবে ৩১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে যখন সম্রাট কনস্তানতাইন খ্রিষ্টধর্মকে সরকারী স্বীকৃতি দান করেছিলেন, খ্রিষ্টানদের উপর নির্যাতন খুবই কমে গেছিল। এর ফলে খ্রিষ্টান হওয়াটি আর তত কঠিন ব্যাপার ছিল না। ঠিক এ সময়েই খ্রিষ্টাদর্শকে পুঙ্খানপুঙ্খ রূপে পালন করার জন্যই খ্রিষ্টম-লীর মধ্যে সন্ন্যাস আন্দোলন শুরু হয়। আর এই আন্দোলনের প্রধান একজন ব্যক্তিত্ব হলেন বিজনাশ্রমী সাধু আন্তনি।
মহাত্মা আন্তনি ২৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মিশরের উত্তর অঞ্চলে একটি ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মিশরীয় আন্তনি, মরুবাসী আন্তনি ও বিজনাশ্রমী আন্তনি বলেও পরিচিত। তিনি সেই মরুবাসী পিতৃগণের পথের দিশারী বলে গণ্য ছিলেন, যারা ৩য় ও ৪র্থ শতাব্দীতে মিশরের প্রান্তরে সন্ন্যাস জীবন পালন করছিলেন। একদিন যিশুর এই বাক্য শুনে ‘তুমি যদি সিদ্ধপুরুষ হতে চাও, তাহলে যাও, তোমার যা কিছু আছে সবই বিক্রি করে গরিবদের দান কর তবেই স্বর্গে তোমার জন্য ধন গচ্ছিত থাকবে, পরে আমার অনুসরণ কর’ তিনি সবকিছু বিক্রি করে গরিবদের বিলিয়ে দিয়ে লোকালয় ছেড়ে মরুপ্রান্তরে চলে গেলেন। তিনি প্রথম খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী এমনকি খ্রিষ্টান সন্ন্যাসজীবনের আদিপিতা বলে পরিগণিত। তিনি একাকি হয়ে পবিত্র বাইবেলে ও মরুপ্রান্তরের নির্জনতায় ঈশ্বরের অন্বেষণ করলেন। কয়েক বছর পর লোকে তাঁকে সাধু বলে গণ্য করায় তাঁর কাছে পরামর্শ ও প্রার্থনার জন্য আসতে লাগল। তাঁর লিখিত ‘আন্তনির জীবনি’-তে আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মপাল সাধু আথানাসিউস একথা বলেন যে, আন্তনি সমগ্র বাইবেল মুখস্থ করেছিলেন, যার ফলে লোকেরা তাঁকে দেখে স্বয়ং খ্রিষ্টকেই দেখতেন। তিনি ৩৫৬ খ্রিষ্টব্দে প্রাণত্যাগ করেন ৷ আপন শিষ্যদের কাছে এমন নির্দেশ রেখে গেছিলেন যেন তাঁর মৃতদেহ গোপন স্থানে সমাধি দেওয়া হয় যাতে করে তাঁর মৃতদেহ জনগণের ভক্তির বস্তু না হয়।
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে সাধু আন্তনিকে ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় নানা কিংবদন্তির কথা শোনা যায়। ভক্তদের অনেকের মতে সাধু আন্তনি ছিলেন মঙ্গলবিধায়ক। তিনি ছিলেন অলৌকিক কর্মসাধক, দাতা ও ত্যাগী। তিনি মানুষের অসাধ্য আশা-আকাঙ্খা পূরণ করেন। তাঁর কাছে মানুষ যা চায় ঈশ্বরের কৃপায় তাই তিনি দান করেন। এই প্রত্যাশা পূরণের লক্ষে নাটোরের বনপাড়া মিশনারী এলাকায় সাধু আন্তনির গান নামে একটি সংঘবদ্ধ গানের দল সৃষ্টি হয়েছে ৷ এই দলের মূল পরিচালক হলেন দীপক গমেজ ৷ কথা প্রসঙ্গে দীপক গমেজ বলেন, সাধু আন্তনি ‘পৃথিবীর সাধু’ হিসেবে পরিচিত। সর্বজন প্রিয় এই সাধু আন্তনি ছিলেন ঐশিজ্ঞানের আঁধার, মঙ্গলসমাচারের সুদক্ষ প্রচারক, নিঃস্ব অসহায় মানুষের বন্ধু, পাপীর মন পরিবর্তন, রোগীদের সুস্থ্যতাকারী বহুগুণে গুণান্বিত এক মহান সিদ্ধ পুরুষ। বিগত প্রায় আটশত বছর ঈশ্বর তাঁর এই ন¤্র ও বিনীত সেবকের মধ্য দিয়ে ভক্তপ্রাণ মানুষকে অসংখ্য অনুগ্র্রহ দান করেন। তাই সাধারণ মানুষ জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁর মধ্যস্থতা কামনা করেন। অনেকে বিপদাপদে নিজেরা সাধু আন্তনির মধ্যস্থতা কামনা এবং প্রিয়জনদের তাঁর শরনাপন্ন হতে পরামর্শ দেন। অনেকেই পালা গানের মাধ্যমে, নভেনা করে, তীর্থ করে, মানত করে সাধু আন্তনির গুণগান করে থাকেন। সাধু আন্তনির অসংখ্য ভক্তের ভক্তির শ্রোতধারা যেন দিনে দিনে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে ৷
বিবাহ, জন্মদিন, সন্তান কামনা, রোগমুক্তি, ব্যবসায় উন্নতি, ধনলাভ, পারিবারিক মঙ্গলকামনা সহো ইত্যাদি কারনে খ্রীষ্টান সম্প্রদায় বাড়িতে সাধু আন্তনির পালা দিয়ে থাকে ৷ এই পালা তিনদিন ব্যাপি চলমান থাকে ৷ শুধু মাত্র সকালের নাস্তা , দুপুরের খাবার, সন্ধ্যার নামাজের বিরতি ছাড়া অবিরাম ভাবে চলতে থাকে এই পালা গান ৷
গায়েনরা বিভিন্ন রুপে সেজে, দর্শকদের আকর্ষণের জন্য অভিনয়ের মাধ্যমে সাধু আন্তনির অতীত জীবন, তার ধর্মচার থেকে শুরু করে তার আদি-অন্ত গুলো গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে শোতাদের মুগ্ধ করে তোলে৷ যারা এ পালায় অংশ নিয়েছেন তারা হলেন- দীপক গমেজ, মিলন রোজারিও, সুব্রত ডি কস্তা, ফেলু গমেজ, ডগনাস হেমব্রেম, সিলবেস্টার গায়েন, অরুন পিউরি ফিকেশান সহো সাত-আট জনের একটি দল ৷ সঙ্গীতের অনুষঙ্গ হিসেবে খোল, জুড়ি, হারমোনিয়াম ব্যবহার করা হয় ৷ এছাড়া মূল গায়েনের হাতে ঘোড়ার পুচ্ছের একটি ছড়ি থাকে ৷ তিনি গানের পয়ার বলে যান এবং অন্যেরা দোয়ারি ধরে ৷ এছাড়া দ্রুত লয়ের গানের সময় নৃত্যাভিনয়েরও প্রদর্শন লক্ষ করা যায় ৷ সাধু আন্তনির দলের পরিচালক দীপক গমেজ জানান, নাটোর -রাজশাহী জেলায় তাদেরই একটি দল এখন টিকে আছে ৷ তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে অর্থের বিনিময়েও গান করতে যান ৷ পরিশেষে বলতে হয় সাধু আন্তনির পালা গ্রাম বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে প্রযুক্তির বিকাশ ও দেশের ডিজিটালাইজেশনের ফলে বাংলাদেশের স্বকীয় সংস্কৃতি আজ বিস্মৃতির পথে ধাবমান ৷
গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমাদের দেশীয় প্রাণের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি অন্তত স্তব্ধ না হয়ে চলমান থাকবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করি ৷
লেখক:
ভাস্কর সরকার,
পিএইচ.ডি গবেষক,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ।