নাজমুল হাসান, বিশেষ প্রতিবেদক: নাটোরে মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের জন্য মেডিকেল রিপোর্ট আনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন শতাধিক সন্তানসম্ভাবা নারী। ঘটনাটি ঘটেছে সদর উপজেলার লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নে। অভিযোগ রয়েছে, মেডিকেল রিপোর্ট আনতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীর দারস্থ হন তারা। সুইটি রানী তাদের পাঠান ‘হেলথ কেয়ার’ নামে শহরের চকরামপুর এলাকার একটি ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারে। সেখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই আলট্রাসনোগ্রাফির পাশাপাশি একগাদা পরীক্ষা করিয়ে এ পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়া হয়েছে গরীব অসহায়দের চার লক্ষাধিক টাকা। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের কর্মকর্তা। ইতিমধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
সদর উপজেলার গাজিপুর বিল এলাকার গিয়ে কথা হয় সন্তানসম্ভবা জরিনা খাতুনের সাথে। তিনি জানান, মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের আবেদনের প্রয়োজনে মেডিকেল রিপোর্টের জন্য কিছুদিন আগে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীর দারস্থ হন তিনি। পরে সুইটি রানী তাকে পাঠিয়ে দেন ‘হেলথ কেয়ার’ নামে শহরের একটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে। সেখানে আলট্রাসনোগ্রাফির পাশাপাশি অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই একগাদা পরীক্ষা করে নেয়া হয় ১৬শ টাকা।
একই অভিযোগ করেন, পাশ্ববর্তী আটঘরিয়া গ্রামের গৃহবধু শাহিদা। তিনি জানান, বনপাড়ার জাহেদা হাসপাতাল থেকে তিনি আলট্রাসনোগ্রাফি করান। সেই রিপোর্ট নিয়ে সুইটি রানীর কাছে গেলে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার আগের কাগজপত্র চলবে না বলে জানান সুইটি। পরে হেলথ কেয়ারে নানা পরীক্ষার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয় ২৫শ টাকা। পুরো ইউনিয়নে সাথী, পাপিয়া, জেসমিন, আঁখি, লাইলি, আলেয়াসহ ১৩২ জন নারীর সাথে একই ঘটনা ঘটেছে দাবী করে ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার দাবী জানিয়েছেন রোগীর স্বজন ও এলাকাবাসি। এ নিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছিল ভুক্তভোগীরা।
সদর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ পরিতোষ কুমার রায় জানান, একজন নারী সন্তানসম্ভবা কিনা তা জানার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে এতোগুলো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র মুত্র পরীক্ষার মাধ্যমেই বিষয়টি জানা যায়। আরেকটু নিশ্চিত হবার জন্য বড়জোর আলট্রাসনোগ্রাফি করা যেতে পারে। এছাড়া সংশ্লিষ্ঠ বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া স্বাস্থ্য পরীক্ষা করারও বিধান নেই।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এতোগুলো পরীক্ষা কেন করানো হলো? সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি হেলথ কেয়ার ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. ইসমাইল হুসাইনের কাছে। তবে সুইটি রানীর সাথে সখ্য থাকার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন তিনি।
ডা. ইসমাইল হুসাইন জানান, রোগীরা এসে যে যে পরীক্ষা করতে বলেছে আমরা শুধু সেই পরীক্ষাগুলোই করেছি। সুইটি রানী স্বাস্থ্য সেক্টরে একজন সরকারী কর্মকর্তা। এই হিসাবে ওনার সাথে আমাদের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। উনি প্রয়োজন মনে করলে অনেক সময় তার পরিচিত জনকে আমাদের এখানে চিকিৎসার জন্য পাঠান।
এদিকে নিজের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবী করছেন অভিযুক্ত সুইটি রানী। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ মিথ্য ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক। তিনি কাউকে হেলথ কেয়ার ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে পাঠাননি। এছাড়াও সুইটি রানী দাম্ভিকতার সাথে বলেন, আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার আগে দুইবার ভাবতে হবে। আপনারা আমাকে নিয়ে অনুসন্ধান করে ভারী অন্যায় কাজ করছেন।
এবিষয়ে লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান নূরুজ্জামান কালু জানান, ইতিমধ্যে ঘটনাটির সমাধান চেয়ে তার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগীরা। ঘটনাটি পরিষদের মাসিক সভায় আলোচনা করে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের দেয়া মেডিকেল রিপোর্টের ভিত্তিতেই মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ডের আবেদন করা যায়। গরীব অসহায় দুঃস্থ গর্ভবতী নারীদের কাছ থেকে সুকৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা সুইটি রানী ন্যাক্কারজনক কাজ করেছেন। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার দাবী জানান তিনি।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ পরিচালক মোসাঃ মাহফুজা খানম জানান, মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের প্রয়োজনে মেডিকেল রিপোর্ট করাতে শতাধিক নারী সুইটি রানীর কাছে যায়। এসময় সুইটি রানী তাদের পাঠিয়ে দেন হেলথ কেয়ার নামে শহরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই আল্ট্রাসনোগ্রাফিসহ অপ্রয়োজনীয় একাধিক পরীক্ষা করে কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এ বিষয় ভুক্তভোগীরা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়। বিষয়টি জেলা প্রশাসনের মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়। এরই প্রেক্ষিতে জেলা পরিবার পরিবার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের ক্লিনিক্যাল কনট্রাসেপসনের সহকারী পরিচালক আব্দুর রউফ মল্লিককে আহ্বায়ক এবং সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান খানকে সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক জেলা পরিবার পরিবার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের ক্লিনিক্যাল কনট্রাসেপসনের সহকারী পরিচালক আব্দুর রউফ মল্লিক জানান, কমিটি গত বৃহস্পতিবার থেকে (১ জুন) তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। তারই অংশ হিসাবে লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান নূরুজ্জামান কালুর উপস্থিতিতে তার কার্যালয়ে ৫ ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনদের সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তারপর তদন্ত কমিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীরও জবানবন্দি গ্রহন করেছেন। তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আগামী ১৩ জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।