বড়াইগ্রাম (নাটোর) প্রতিনিধি :
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ পরিতোষ কুমার রায়ের উদাসীনতায় গোটা বড়াইগ্রাম উপজেলায় শিশু স্বাস্থ্যসেবা হুমকির সম্মুখিন হয়ে পরেছে। আজ ২৫ নভেম্বর বড়াইগ্রাম উপজেলা ও নাটোর সদর থেকে বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য সেবার উপর একটি অনুসন্ধানী রিপর্ট বের হয়। এবিষয়ে “স্বপ্ন সাঁকো” পত্রিকার পক্ষথেকে অনুসন্ধান করলে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত প্রায় ৩ বছর যাবৎ বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন মেডিকেল সহকারী দিয়ে শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। সেখানে নিয়ম অমান্য করে মেডিকেল অফিসারের পরিবর্তে শিশু রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন শাহাবউদ্দিন নামে একজন উপ-সহকারী (স্যাকমো)। স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার উপস্থিত থাকলেও তিনি প্রভাব খাটিয়ে ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে শিশু কর্নারে নিয়মিত রোগী দেখেন এবং উচ্চমাত্রার এন্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড প্রেসক্রিপশন করছেন।যা শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়াসহ ঘন ঘন রোগাক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটাচ্ছে। একজন উপ-সহকারীর ভুল চিকিৎসা শিশুদের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে বড়াইগ্রাম উপজেলায়।
একই সঙ্গে উপ-সহকারীর প্যাথলজিক্যাল টেষ্ট লেখার নিয়ম না থাকলেও শুধুমাত্র কমিশন পাওয়ার লোভে একজন রোগীকে সবোর্চ্চ ৮টি পর্যন্ত টেস্ট দেয়ার প্রমান পাওয়া গেছে। এমনকি বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আশে-পাশের বে-সরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রতিদিন সন্ধার পর প্যাথলজিক্যাল টেস্টের কমিশন নিতে নিজেই চলে যান। এ প্রসঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বরাবর একাধিক অভিযোগ করলেও অজ্ঞাত কারণে তিনি শুধু সতর্কীকরণ নোটিশ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন।
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, কোন রোগী টেস্ট করাতে না চাইলে বা হাসপাতালের মেডিকেল অফিসারের কাছে যেতে চাইলে শাহাবউদ্দিন তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করাতে গিয়ে রোগীরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। তিনি প্রতিদিন বিকালে একাধিক স্থানে নিজেকে শিশু বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিয়ে শিশু রোগী দেখেন। এসব ব্যাপারে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বড়াইগ্রাম এলাকার সাব্বির আহমেদ নামে এক বছর বয়সের একজন রোগীকে তিনি ব্লাড গ্রুপ, সিবিসি, আরবিএস, ইউরিনসহ মোট আটটি প্যাথলজিক্যাল টেস্ট দিয়েছেন। লক্ষীকোল এলাকার সুরভী নামে অপর এক রোগীকে ৬টি টেস্ট দিয়েছেন তিনি। এক রুগীর অভিভাবক আব্দুর রহমান জানান, হাসপাতালে শাহাবউদ্দিনের কাছে চিকিৎসা নেয়ার পর আমার বাচ্চা উল্টো রোগাটে হয়ে যায়। পরে আমি বাচ্চাকে নিয়ে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হলে তিনি শাহাবউদ্দিনের প্রেসক্রিপশন দেখে জানান যে, এই ব্যবস্থা পত্রের ঔষধ খাওয়ানোর কারণেই বাচ্চার স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেমে গেছে এবং রোগাটে হয়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একাধিক মেডিকেল অফিসার ক্ষোভের সঙ্গে জানান, হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার (শিশু) নেমপ্লেট লাগানো একটি কক্ষে বসে নিয়মিত শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছেন শাহাব উদ্দিন। আমরা হাসপাতালে থাকলেও সেই রোগী দেখে। প্রকৃতপক্ষে আইএমসিআই – এ কোন প্রেসক্রিপশন দেওয়ার বিধান নাই। ওখানে আগত বাচ্চাদের পুষ্টিহীনতার মাত্রা পরীক্ষা করে সেগুলো খাতায় লিখে যেমন ওজন, উচ্চতা, বয়স একজন মেডিকেল অফিসারের কাছে পাঠানোর কথা। চিকিৎসক এর পরামর্শ মোতাবেক খাবার স্যালাইম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত পুষ্টিকনা বিতরন ও লিপিবদ্ধ করাই সেখানে দায়িত্বরত মেডিকেল সহকারীর কাজ। তবে সে যেহেতু সেখানে বাচ্চাদের চিকিৎসা দিচ্ছে তাই রোগীরর অভিভাবকরাও শিশু ডাক্তার হিসাবে তাকেই খোঁজ করেন। যা একজন মেডিকেল অফিসার হিসাবে আমাদের জন্য রীতিমত অপমানজনক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বড়াইগ্রাম উপজেলায় প্রায় ৩ থেকে ৪শত গ্রাম্য চিকিৎসক রয়েছেন। তাঁরা গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠান। কিন্তু সেই প্রান্তিক রোগী গুলো উপ-সহাকারীদের ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। জরুরী বিভাগে নিয়মিত রোস্টার ভিত্তিক মেডিকেল অফিসার পাওয়া গেলেও আই.এম.সি.আই কর্নার মেডিকেল অফিসার (শিশু) লেখা রুমে দীর্ঘ প্রায় তিন বছর যাবৎ অজানা কারনে কোন মেডিকেল অফিসার বসতে দেয়া হয়নি। কিন্তু এই শিশু কর্নারটিই সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা, যেখানে একজন মেডিকেল অফিসারের বিকল্প হিসেবে কাউকে ভাবাই অন্যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যাক্তি জানান, যেখানে স্বাস্থ্য বিভাগ এন্টিবায়োটিক ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করছে সেখানে সরকারী হাসপাতালে এভাবে উচ্চ মাত্রার এন্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ লিখে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নীরবে ধংস করে দেয়া হচ্ছে। তারা অবিলম্বে শিশুদের চিকিৎসার জন্য একজন মেডিকেল অফিসারকে দায়িত্ব দেয়ার দাবী জানান।
এ ব্যাপারে মেডিকেল উপ-সহকারী শাহাবউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, রোগীদের সুস্থ করার জন্যই এন্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ লিখি, টেষ্ট করাতে বলি। তবে তিনি নিয়মানুযায়ী প্রেসক্রিপশন করা এবং টেষ্ট করানোর নির্দেশ দিতে পারেন কিনা জানতে চাইলে কোন উত্তর দিতে পারেননি।
এপ্রসঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. পরিতোষ কুমার রায় অভিযোগকারীদের বলেছিলেন- হাসপাতালে পর্যাপ্ত মেডিকেল অফিসার বরাদ্দ না থাকায় শিশু কর্নারে উপ-সহকারীকে দিয়ে দায়িত্ব পালন করাতে হচ্ছে। তবে তার ব্যাপারে আমিও কিছু অভিযোগ পেয়ে তাকে সতর্কীকরণ নোটিশ দিয়েছি। দু, একদিনের মধ্যেই শিশু কর্নারে রোস্টার ভিত্তিক প্রতিদিন একজন করে মেডিকেল অফিসার দেয়া হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা’ শিশু কর্নারে মেডিকেল অফিসার দেয়ার মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেয়ার আট থেকে দশদিন পার হলেও সেখানে এখন পর্যন্ত কোন মেডিকেল অফিসার দেননি।