বনপাড়া-হাটিকুমরুল দ্বিতল মহাসড়ক ও নাটোর-পাবনা সড়কের বড়াইগ্রাম অংশের ৩৭ কিলোমিটার হাইওয়ে সড়কটি যাত্রীদের কাছে এখন রীতিমত আতংকের নাম। এ রাস্তায় চলাচলকারীরা যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই চলাচল করেন। এমনই এক ভয়াবহ পরিসংখ্যান উঠে এসেছে সাম্প্রতিক কালের সড়ক দূর্ঘটানার পরিসংখ্যান থেকে।
গত ২২দিনে শুধু বড়াইগ্রাম অংশের ৩৭ কিলোমিটার হাইওয়ে সড়কেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অন্তত ৭ জন। এছাড়াও আহত হয়েছেন কমপক্ষে শতাধিক মানুষ।
গত ২২ দিনের জরিপ অনুযায়ী, ৭ মে সকাল ১১ টায় নাটোর-ঢাকা ম
হাসড়কের বড়াইগ্রামের গাজী অটো রাইচ মিলের সামনে ন্যাশনাল ট্রাভেলস্ ও সিয়াম স্পেশাল নামের দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৬ জন এবং হাসপাতালে নেয়ার পর মারান যায় ১ জন। ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়ন ৫০ জনের অধিক যাত্রী। ওই দুর্ঘটনায় সিয়াম গাড়ির চালকের ডান পা ও ন্যাশনাল ট্রাভেলস এর হেলপারের বাঁ হাত বিছিন্নসহ ৫ যাত্রী পঙ্গুত্ব বরণ করেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে।
একই দিন(৭ মে) সন্ধ্যায় অপর এক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়। নাটোর-পাবনা মহাসড়কের উপজেলার বনপাড়া ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সামনে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
১৭ মে নাটোর-ঢাকা মহাসড়কের উপজেলার থানার মোড় এলাকায় দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে লিটন দফাদার (৪২) নামে এক ট্রাকচালক নিহত হয়েছেন। এসময় গুরুতর আহত হেলপারকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গত ১৮ মে রাত ৩টার দিকে নাটোর-পাবনা মহাসড়কের উপজেলার নগর কয়েন বাজার এলাকায় বালু ভর্তি ট্রাকের সাথে যাত্রীবাহি মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত ও ৩ জন আহত হন।
সর্বশেষ গত ২৫ মে বেলা সারে এগারোটার দিকে বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের শ্রীরামপুর নামক স্থানে নুরে আলম ফিলিং স্টেশনের (তরমুজ পেট্রোল পাম্প) কাছে হানিফ পরিবহনের বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারান বাস চালক এবং গুরুতর আহত হন ৪ জন।
ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত করা নামি-দামি বাসগুলোই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। স্থানীয় জন সাধারন ও বড়াইগ্রাম হাইওয়ে থানার মতে এসকল বাস ঢাকার জ্যাম মোকাবেলা করতে গিয়ে যে সময় ব্যয় করে তা এই বনপাড়া-হাটিকুমরুল দ্বিতল মহাসড়কে এসে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্ঠা করে থাকে। ফলে বর্তমানে এই রাস্তায় চলাচলকারী ভিআইপি খ্যাত বাস গুলো দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এসকল বাসের চালকদের সিগ্নাল না মানা, ওভার টেকিং করা, দ্রুত গতিই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ঠরা। এছাড়াও মহাসড়কের পাশে ট্রাক পার্কিং করে মালামাল উঠানো বা নামানো, বাস গুলোর যাত্রী ছাউনী ব্যবহার না করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যাত্রি উঠানো বা নামামোও দুর্ঘটনার সৃষ্টি করেছে বলেও দাবি অনেকেরই।
সরজমিনে এই মহাসড়কটির বড়াইগ্রাম অংশ পরির্দশন করে দেখা গেছে, বড়াইগ্রাম অংশে অন্তত নয়টি বাঁক আছে। এই বাঁকগুলোতেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। মহাসড়কে নয়টি বাঁক হলো- উপজেলার বনপাড়া অংশের গাজী অটোরাইস মিলের সামনের মোড়, আগ্রান বাজারে, বড়াইগ্রাম থানা মোড়, রেজুর মোড়, রেজ্জাক মোড়, চকপাড়া মোড়, মানিকপুর মোড়, কলাবাগান মোড় এবং আইড়মারি ব্রিজ এলাকার মোড়। এই নয় মোড়েই ঘটছে বড় বড় দুর্ঘটনা।
গত ২১ মে এই দ্বিতল মহাসড়কের দুর্ঘটনার তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধি দল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এই প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হলেন, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক) মো. আনিসুর রহমান, বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রাব্বানী, বগুড়া হাইওয়ে পুলিশ সুপার মুন্সী শাহাবুদ্দিন, সড়ক ও জনপদ বিভাগের তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী তানভির সিদ্দিক সহ বিআরটিএ ও সড়ক ও জনপদ বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তাগণ।
পরিদর্শন শেষে কমিটি প্রধান যুগ্ম সচিব মো. আনিসুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, “গত ৭ মে বনপাড়া-ঢাকা মহাসড়কের বড়াইগ্রামের বনপাড়াতে দুই বাস ও ট্রাকের সাথে ত্রিমুখী সংঘর্ষে ৭ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন যাত্রী গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনার কারণ নির্ণয় করতে মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি এই তদন্তে আসে। এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে পাশাপাশি এই মহাসড়কে সাম্প্রতিক অন্যান্য দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করতে ঘটনাস্থল সহ মহাসড়ক পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিদর্শন ও তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দুর্ঘটনা রোধে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ করা হবে ও তা অনুমোদন সাপেক্ষে দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।”
২০০২ সালে উদ্বোধন হওয়া নাটোরের বনপাড়া থেকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল এই মহাসড়কে এ পর্যন্ত দুর্ঘটনায় সাত শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। হাত-পা হারিয়ে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
বনপাড়া হাইওয়ে থানা সূত্রে জানা গেছে, এ মহাসড়কে ২০১৯ থেকে এ পর্যন্ত ৪৫টি দুর্ঘটনায় ১২৭ জন নিহত হন। এ ছাড়া ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪২টি দুর্ঘটনায় ১২৯ জন, ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ৩৯টি দুর্ঘটনায় ১০৮, ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ৮৭ জন এবং ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৩৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩৯ জন নিহত হয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১৪ সালে ১১৫ জন নিহত হন। সে বছর ২০ অক্টোবর এ মহাসড়কের রেজুর মোড়ে দুর্ঘটনায় ৩৮ জন নিহত এবং ৪০ জন আহত হন। ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী হানিফ পরিবহনের সঙ্গে অথৈ পরিবহনের মধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার কারণ ক্ষতিয়ে দেখতে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি তিনটি কারণ চিহ্নিত করাসহ ১৭টি সুপারিশ করেন।
সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে রেজুর মোড়সহ কয়েকটি মোড় সম্প্রসারণ, অধিক বাঁকা মোড় কিছুটা সোজাকরণ, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের চালক, মালিক ও এলাকাবাসীকে সচেতন করা।
এ দুর্ঘটনার পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি রেজুর মোড়সহ কয়েকটি মোড় সম্প্রসারণের আশ্বাস দেন। কিন্তু সেই আশ্বাস ও সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে মৃত্যুর মিছিল থামছে না।
নিরাপদ সড়ক চাইয়ের নাটোর জেলা সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, “বনপাড়া বাইপাসের পরপর কয়েকটি মোড় রয়েছে। এ কারণে বারবার বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি আরও বলেন, এসব মোড় সম্প্রসারণসহ তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে দুর্ঘটনা কমবে।”
বনপাড়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান জানান, “মহাসড়কে যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং বন্ধ করাসহ স্পিডগানের মাধ্যমে অতিরিক্ত গতিসম্পন্ন গাড়ির নামে মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া চালক ও তাঁদের সহকারীদের মধ্যে প্রচারপত্র বিতরণ করাসহ যাত্রীদেরও নানাভাবে সচেতন করা হচ্ছে।”
বনপাড়া হাইওয়ে থানার ওসি মশিউর রহমান জানান, “সড়কে যানবাহনের চাপ অনেক বেশি। এক্ষেত্রে সড়ক প্রশস্ত করা জরুরী। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে হাইওয়ে থানা পুলিশ তৎপর রয়েছে। তবে দীর্ঘ ৩৭ কিলোমিটার মহাসড়কের চলাচলকারী যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে গুরুত্বপুর্ণ জায়গাগুলোতে সার্বক্ষণিক পুলিশি চেকপোস্ট স্থাপন করতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করছেন।”
বড়ইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সিদ্দিক বলেন, “ পূর্বের বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও সাম্প্রতিক কালের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ যৌথভাবে মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে কাজ করছে।”
বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মরিয়াম খাতুন জানান, “এটি দুর্ঘটনাপ্রবণ মহাসড়ক। একটি দুর্ঘটনার তদন্তে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন। তিনি তাঁকে এই মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানিয়েছেন। জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি লিখিতভাবে তুলে ধরবেন।”