বড়াইগ্রাম প্রতিনিধি : ‘আমার আব্বুকে ওরা কোথায় নিয়ে গেলো, ‘আমার আব্বুকে ওরা কোথায় নিয়ে গেলো’ বলে বুক চাপড়ে কাঁদছিলো, আর বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল ছোট্ট শিশুটি (১০)। স্বজনরা কেউ তার মাথায় পানি ঢালছিলেন, কেউ হাত পা ম্যাসেজ করে গরম করার চেষ্টা করছিলেন। চেতনা ফিরতেই আবারও আব্বু আব্বু বলে কেঁদে উঠছিল শিশুটি। বুক ভাঙ্গা কান্নার শব্দে চেনা-অচেনা অনেকেই কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে টেনে নিলেও তাকে শান্তনা দেবার মত ভাষা ছিলো না কারও, বরং ওর কান্নার সাথী হয়ে অঝোরে কেঁদেছেন আশেপাশে উপস্থিত চিকিৎসক, কর্মচারী, রোগীসহ সব পর্যায়ের মানুষ। মঙ্গলবার রাতে বড়াইগ্রাম হাসপাতাল চত্তরের চিত্র ছিলো এটি।
অকালে প্রিয় পিতাকে হারিয়ে শিশু জীবন আহমেদ নিজেও আর্তনাদ করে কেঁদেছে, কাঁদিয়েছে উপস্থিত সবাইকে। হাসপাতাল থেকে মৃত ঘোষণার পর পুলিশ যখন নিহত মনিরুলের মরদেহ পোষ্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল তখন কিছুক্ষণ আগে দেখা জীবন্ত পিতাকে এভাবে মরদেহ হয়ে সাদা প্লাষ্টিক কভারে ভরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলো না শিশু জীবন। জীবন আহমেদ নিহত মনিরুলের ছেলে বড় ছেলে। মঙ্গলবার সুদের মাত্র ৫ হাজার টাকার জন্য সৎ বড় ভাই, ভাবী ও বোন মিলে পিটিয়ে হত্যা করেছে বড়াইগ্রামের চকপাড়া গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে মনিরুল ইসলাম (৩৪) কে।
জানা যায়, দিন মজুর মনিরুল ইসলামের দুই ছেলে। বড় ছেলে জীবন বড়াইগ্রাম শিশু একাডেমীতে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে। আর ছোট ছেলে সিজান আহমেদের বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর। মনিরুল নিজে লেখাপড়া করতে না পারলেও ছেলেদেরকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করার স্বপ্ন দেখতেন। সে জন্যই বেশি টাকা খরচ হলেও ছেলেকে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়েছিলেন। আশা ছিলো ছেলে লেখাপড়া শিখে জীবনে বড় হবে। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণের আগেই সৎ ভাই মানিক হোসেন, ভাবী শরীফা আর বোন উম্মেহানীর মারপিটে অকালে মারা যান তিনি।
জীবনের মা রাণী বেগম ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, সুদের উপরে পাঁচ হাজার টাকা নিলেও দুই দফায় ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি, তারপরও নাকি তার সুদ পরিশোধ হয়নি। সে টাকার জন্য আমার ছাগল কেড়ে নিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত আমার স্বামীকেই মেরে ফেললো। বড় ভাই বোন হয়ে এমন নির্মম ভাবে আমার স্বামীকে মেরে ফেললো তারা।
তিনি বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, স্বামীই ছিলো সংসারে আয়ের একমাত্র উৎস। ছেলে দুটোকে মানুষ করার তীব্র আশা ছিলো তার। এখন স্বামীহীন সংসারে লেখাপড়াতো দুরের কথা, আমি এ মাসুম শিশু দুটিকে তিন বেলা খাবার দেবো কিভাবে, কে দেখবে আমাদেরকে।
মানবাধিকার কর্মী ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) উপজেলা সভাপতি খাদেমুল ইসলাম বলেন, দিন দিন মানুষ চরম অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। তারই ধারাবাহিকতায় সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি তরতাজা প্রাণ হারিয়ে গেলো। একই সঙ্গে চরম অনিশ্চতার মুখে পড়লো নিষ্পাপ দুটি শিশুসহ তিনটি মানুষের ভবিষ্যৎ। অথচ কিছুটা আন্তরিক হলেই খুব সহজে সমস্যাটির সমাধান করা যেতো।
বড়াইগ্রাম থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আব্দুর রহিম জানান, মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে।