সিলেটের সরকারি মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে শুক্রবার সন্ধ্যায় গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ। পরে রাত ১০টার দিকে শাহপরাণ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্যাতিতা গৃহবধূ ও তার স্বামীকে উদ্ধার করে। এই ঘটনায় গতকাল সকালে ৯ জনকে আসামি করে শাহপরাণ থানায় ধর্ষিতার স্বামী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ৬ ছাত্রলীগ কর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা হলেন- এম সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেক আহমদ, অর্জুন লঙ্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান। তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আসামিদের মধ্যে তারেক ও রবিউল বহিরাগত এবং বাকিরা এমসি কলেজের ছাত্র।
জানা গেছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় স্বামীকে নিয়ে এমসি কলেজ এলাকায় ঘুরতে গিয়েছিলেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকার এক গৃহবধূ। এ সময় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে এম সাইফুর রহমান ও শাহ মাহবুবুর রহমান রনির নেতৃত্বে স্বামী-স্ত্রীকে পার্শ্ববর্তী কলেজ ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের ৬ কর্মী। সেখানে একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। খবর পেয়ে রাত ১০টার দিকে শাহপরাণ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে উদ্ধার করে এবং নির্যাতিতাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন। এদিকে এ ঘটনার পরপরই অভিযানে নামে পুলিশ। গণধর্ষণ ঘটনার মূল হোতা ছাত্রলীগ ক্যাডার এম সাইফুর রহমানের রুম থেকে দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার দিবাগত রাত ২টার দিকে শাহপরাণ থানা পুলিশ এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অভিযান চালায়। এ বিষয়ে শাহপরাণ থানার ওসি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী জানান, ধর্ষণের ঘটনার পর রাতে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অভিযান চালানো হয়। এ সময় সাইফুর রহমানের রুম থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র ও ছোরা উদ্ধার করা হয়। তবে অভিযুক্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনেও আরেকটি মামলা হয়েছে বলে ওসি জানান।অভিযোগ রয়েছে, সরকারের নির্দেশনা অমান্য করেই সিলেট এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষ বহিরাগতসহ কলেজ শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। করোনা সংক্রমণের কারণে মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে প্রভাব খাটিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে থাকত ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। সব কিছু জানার পরও মুখ বন্ধ করে থাকত কলেজ কর্তৃপক্ষ। বহিরাগত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি কলেজের বিভিন্ন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ছাত্রাবাসে বসবাস করে আসছিলেন। বিষয়টি কলেজ কর্তৃপক্ষের জানা থাকলেও কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সালেহ উদ্দিন বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার পর পরই নোটিস দিয়ে কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে কিছু শিক্ষার্থী কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি ও টিউশনি করেন। সেইসব শিক্ষার্থী ছাত্রাবাসে থাকার জন্য হোস্টেল সুপারের মাধ্যমে আমাকে বিষয়টি জানিয়েছিল। তখন আমি হোস্টেল সুপারকে বলেছি যারা বৈধ তাদের কয়েকজনকে ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন, ছাত্রাবাসের ৬টি ব্লক ও পূর্ব দিকে একটি ৪তলা ভবনে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী থাকত। কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ হওয়ার পর মানবিক দিক বিবেচনা করে ছাত্রাবাসে প্রায় ২০-৩০ জনকে থাকতে মৌখিকভাবে বলা হয়। শুক্রবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তল্লাশি করে ছাত্রাবাসের কয়েকটি কক্ষ বন্ধ করা হয়। এদিকে ধর্ষক ছাত্রলীগকর্মীদের শাস্তি চান সিলেট আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, ধর্ষণকরীদের কোনো পরিচয় নেই। তাদের পরিচয় শুধু তারা অপরাধী। এই লজ্জাজনক ঘটনায় আমরা অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। ইতিমধ্যে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে কথাও হয়েছে। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান বলেন, কেউ অপরাধ করলে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। ইতিমধ্যে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলে দিয়েছি অপরাধী যারাই হোক তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য। এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনা খুবই জঘন্য এবং নিন্দনীয়। আমরা অপরাধীদের শাস্তি চাই।
ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ : ছাত্রাবাসে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় এমসি কলেজের ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। গতকাল দুপুরের মধ্যে ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। করোনার সময়ে হোস্টেল বন্ধ থাকলেও ছাত্ররা কীভাবে ছাত্রাবাসে থাকছে জানতে চাইলে হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিন বলেন, কলেজ বন্ধ, হোস্টেলও বন্ধ রয়েছে। তবে কিছু শিক্ষার্থী টিউশনি করানোর কারণে ছাত্রাবাসে থাকছেন। যারা এখন হল ছাড়বে না তাদের বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।
সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ : কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনায় আন্দোলনে নেমেছেন এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে এমসি কলেজের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী কলেজের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তারা ধর্ষকদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন।
তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি : এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত কার্যদিবসের মধ্যে এই কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ছাত্রাবাসের দুই নিরাপত্তাকর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ উদ্দিন জানান, কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জীবন কৃষ্ণ আচার্য্য ও একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে শেষের দুজন হোস্টেল সুপারের দায়িত্বে রয়েছেন।
সু্ত্র: বিডি প্রতিদিন