ক্ষুদিরাম বসু (Khudiram Bose )শৈশবেই বাবা মা-কে হারান।মাত্র ১২ বছর বয়সেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।ক্ষুদিরাম তার দিদির কাছে থাকতো,ক্ষুদিরাম স্কুলে পড়াকালীন রিভলবার চেয়ে চমকে দিয়েছিলেন হেমচন্দ্র কানুনগোকে।মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথমবার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হাতে বোমা তুলে নেন।একাধিকবার পুলিশের হাতে ধরাও পড়েন।
১৯০৪ সালে দিদি অনুরূপা দেবীর স্বামী অমৃতলাল বদলি হলেন মেদিনীপুরে। সেখানে সরকারী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হল ক্ষুদিরাম। সে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী সত্যেন বসু। ক্ষুদিরামকে তাঁর খুবই পছন্দ হল। তিনি মনে মনে বিপ্লবের জন্য বেছে নিলেন তাকে।
প্রথমে ব্যায়াম করা, রোগীর সেবা করা এই সব সমাজ সেবার কাজ চলল। তার পর গীতা-পড়া, বিপ্লবীদের জীবনী-পড়া চলতে থাকল। ক্রমে ক্ষুদিরাম যুগান্তর নামের এক বিপ্লবীদলের কর্মী হয়ে উঠল।
এমন সময় একবার সেখানে হল এক কৃষিমেলা। মেলার গেটে একজন বিপ্লবী বই বিক্রি করছে। কে? স্কুলের একজন ইংরেজ ভজা শিক্ষক চিনলেন ছেলেটিকে। সে ক্ষুদিরাম। শিক্ষক মশাই সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে পুলিশ ডেকে আনলেন। পুলিশ যেই ধরতে গেল ক্ষুদিরামকে অমনি সে তার নাকে এক ঘুসি মেরে পালাল। পরে অবশ্য ধরা পড়ল সে। কিন্তু বয়স কম বলে তেমন শাস্তি হল না। কিন্তু সরকারী চাকুরে অমৃতলাল তাকে আর বাড়িতে থাকতে দিলেন না। এক মুসলমান উকিলের বোনের বাড়িতে থেকে দেশের কাজ করে যেতে থাকল সে।
কাঁসাই নদীতে হল বন্যা। ক্ষুদিরাম দিনরাত বন্যার্তদের সেবা করে চলল। কখনও দিনে ষাট-সত্তর মাইল পর্যন্ত ঘুরত ক্ষুদিরাম। এজন্য সে ব্যবহার করত রণপা।
এই সমর কলকাতা হাইকোর্টের চিফ ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন কিংসফোর্ড। যে সব পত্র-পত্রিকা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লিখত তাদের শাস্তি দেবার দায়িত্ব নিলেন তিনি। ‘সন্ধ্যা’ কাগজের সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধবকে বন্দী করা হল। তিনি বললেন ইংরেজ-কারাগার আমাকে বন্দী করে রাখতে পারবে না। সত্যিই পারল না। তিনি জেলেই মারা গেলেন। অরবিন্দকে বন্দী করা হল এক প্রবন্ধ লিখবার জন্য। প্রমাণের জন্য ডাকা হল বিপিন পালকে সাক্ষ্য দিতে। বিপিন পাল বললেন, আমি ইংরেজদের হয়ে সাক্ষ্য দেব না। ফলে তাঁকেই জেলে পাঠাল বিচারক—অরবিন্দ ছাড়া পেলেন।
বিপ্লবীরা স্থির করল কিংসফোর্ডকে এজন্য জীবন দিতে হবে।
একটা বই এলো কিংসফোর্ডের কাছে। ভাগ্য ভাল তিনি বইটি খুললেন না। কদিন পরে একজন বইটা খুলতেই তার ভেতরে গর্ত করে রাখা এক বোমা ফাটল। মারা গেল কাজের লোকটি। ইংরেজরা কিংসফোর্ডকে তাড়াতাড়ি মজঃফরপুরে বদলি করে দিল। তখন,বিপ্লবীরা স্থির করল সেখানেই মারা হবে কিংসফোর্ডকে। সত্যেন্দ্রনাথ ক্ষুদিরামকে নির্বাচন করলেন। তাঁর সঙ্গে দেওয়া হল আর এক কিশোরকে। তার নাম প্রফুল্ল চাকী।
মার্চ মাসের এক সন্ধ্যায় ওরা দুজনে নামল মজঃফরপুরে। ওরা এসে উঠল এক ধর্মশালায়। সেখান থেকে তারা জেনে নিল মজঃফরপুরের রাস্তা-ঘাট কদিনেই জেনে নিল কিংসফোর্ডের গতিবিধি। তাঁর বাড়ির কাছেই ছিল ইংরেজদের এক ক্লাব। রোজ সন্ধ্যায় সেখানে যান তিনি। ফেরেন রাতে। এই ফেরার পথেই তাঁকে আক্রমণ করা হবে বলে স্থির করল তারা।
১৯০৮ সাল। ৩০শে এপ্রিল। অমাবস্যার আঁধারে ক্লাবের কাছেই বোমা আর পিস্তল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল ওরা। রাত প্রায় আটটার কাছাকাছি কিংসফোর্ডের ঘোড়ার গাড়ি বেরিয়ে এলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে বোমা ছুঁড়ল। গাড়ি টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ওরা রেললাইন ধরে ছুটল সমস্তিপুরের দিকে।
কিন্তু হায় ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল। সেদিন মজঃফরপুরের এক উকিল মিঃ কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা ছিলেন গাড়িতে। তাঁদের পৌঁছে দিতে বেরিয়েছিল গাড়িখানা। মারা গেলেন তাঁরা।
এক রাতে প্রায় তেইশ মাইল পার হয়ে এল প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম। ওয়ানি স্টেশনের এক কলে জল খেতে গিয়েছিল ক্ষুদিরাম। তাকে চেপে ধরল এক পুলিশ। টানাটানিতে তার পিস্তল বেরিয়ে পড়ল। ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে গেল। তার অবস্থা দেখে পালাল প্রফুল্ল।
সমস্তিপুরে এক ভদ্রলোক প্রফুল্লকে আশ্রয় দেন। সেখানে দুদিন থেকে কলকাতার দিকে রওনা হল প্রফুল্ল। সেই গাড়িতেই যাচ্ছিল নন্দলাল ব্যানার্জি নামে এক পুলিশ ইনস্পেক্টর। মোকামা স্টেশনে নন্দলাল কজন পুলিশ ডেকে এনে ঘিরে ফেলল। প্রফুল্ল গুলি চালাল। অল্পের জন্য বেঁচে গেল নন্দলাল। প্রফুল্ল দেখল ধরা সে পড়বেই। সে পর পর দুবার গুলি করল নিজের দেহে। পুলিশ তার মাথা কেটে নিয়ে গেল মজঃফরপুরে।
ওয়ানি থেকে ট্রেনে করে ক্ষুদিরামকে নিয়ে যাওয়া হল মজঃফরপুরে। স্টেশন লোকে লোকময়। ক্ষুদিরাম মৃদু হেসে চিৎকার করে ওঠে ‘বন্দে মাতরম্’। জনতাও চিৎকার করে বলে ‘বন্দে মাতরম্’ । ভয় পেয়ে যায় পুলিশ। লোকেরা ছিনিয়ে নেবে নাকি! তাড়াতাড়ি গাড়ি করে জেলে নিয়ে যায় তাকে।
বিচারের নামে খেলা করা হল। ১৩ই জুন বিচারক ক্ষুদিরামের ফাঁসির হুকুম দিলেন। বললেন, তোমার কি কিছু ইচ্ছা করে?
কিশোর ক্ষুদিরাম বলল, করে বই কি। দিদিকে দেখতে ইচ্ছে করে। আর ইচ্ছে করে দেশের লোককে বোমা তৈরী করবার কৌশল শিখিয়ে দিতে।
বিচারক হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। এ কি ছেলে রে বাবা! ফাঁসির হুকুম শুনেও কাঁপে না!
সত্যিই কাঁপল না ক্ষুদিরাম। যে কদিন তাকে ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করতে হল সে কদিন খেল নিয়মিত, ঘুমাল এবং গীতা পড়ল। ১৯০৮ সাল। ১১ই আগষ্ট। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে স্নান করল ক্ষুদিরাম। আঙ্গুল দিয়ে আঁচড়ে নিল চুলগুলো। তার কোমরে দড়ি বাঁধা। দুজন পুলিশ তাকে যেন টেনে নিয়ে চলল ফাঁসির মঞ্চের দিকে। জেল গেটের বাইরে হাজার হাজার লোক অপেক্ষা করছে। তাদের যেটুকু দেখা গেল—হাসল ক্ষুদিরাম। তার হাত দুটো বেঁধে দেওয়া হল পিছন দিকে। একটা কাল রংয়ের কাপড় দিয়ে তার চোখ-মুখ থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে দেওয়া হল । মোম লাগান দড়িটা পরিয়ে দেওয়া হল গলায়। ক্ষুদিরাম দড়িটা ঠিক করে দিতে বলল। তারপর চিৎকার করে উঠল—বন্দে মাতরম্।
উডম্যান সাহেব রুমাল উড়িয়ে দিলেন। প্রহরী মঞ্চের এক প্রান্তের হাতল টানল। ক্ষুদিরাম ঝুলে পড়ল কুয়োর মধ্যে। দড়িটা নড়তে থাকল।
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।”
এই বাংলা দেশাত্মবোধক গানটি রচনা ও সুর করেন বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস মতান্তরে মুকুন্দ দাস। এটি ভারতীয় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর সম্মানে রচিত।
না ক্ষুদিরাম মরেনি ক্ষুদিরাম আজও আমাদের মনে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে আর সারা জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ফাঁসীর এই দিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই বিপ্লবীকে।
তথ্য সূত্রঃ ইন্টারনেট।